বিশেষ প্রতিনিধি বরগুনার আমতলীর খুরিয়া ঘাট এলাকা থেকে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ৫৩ পিস ইয়াবাসহ ১১ বছরের এক শিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩১ মে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। গত ১২ নভেম্বর এ মামলায় রায় দেন বরগুনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মশিউর রহমান খান। রায়ে ওই কিশোরকে তিন বছর আটকাদেশ দিয়ে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।একই আদালত ২৬ সেপ্টেম্বর বরগুনা সদর উপজেলার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুজন হৃদয় হত্যা মামলায় ১২ শিশুকে ১০ বছর এবং চার শিশুকে সাত বছর করে আটকাদেশ দেন। ওই শিশুদেরও যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এই শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে অন্য সাজা ভোগ করবে বরগুনা জেলা কারাগারে।কিশোর সুজন হৃদয় ২০২০ সালের ২৬ মে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে খুন হয়।
দুটি মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাদক মামলায় আটকাদেশ পাওয়া শিশুটির বয়স এখন ১৬। সে প্রথম দিকে কিছুদিন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকলেও পরে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এবার চূড়ান্ত বিচারে তিন বছরের আটকাদেশ পাওয়ায় তাকে প্রথম দুই বছর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আইন অনুযায়ী পরবর্তী এক বছর জেলে কাটাতে হবে। একইভাবে সুজন হৃদয় হত্যা মামলায় আটকাদেশ পাওয়া শিশুদেরও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর জেলে কাটাতে হবে। অথচ শিশু আইনে বিচার সম্পন্ন হলে দুটি মামলায় আটকাদেশ পাওয়া শিশুদের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রেই থাকার কথা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হওয়ায় কিশোর বয়স পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের কারাগারে অপরাধীদের সঙ্গে থাকতে হবে, যা তাদের অবশিষ্ট দীর্ঘ জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।শিশু আইনের ২০১৩-এর ৩২(ক) ধারায় বলা আছে, ‘অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালত উক্ত আদালতে শিশুর প্রথম উপস্থিত হওয়ার তারিখ হতে ৩৬০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করবে।’ ৩২(খ) ধারায় বলা আছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে কারণ উল্লেখ করে সর্বোচ্চ আরও ৬০ দিন বিচারকাজের সময়সীমা বাড়ানো যাবে। অর্থাৎ ১৪ মাসের মধ্যে বিচার শেষ করতেই হবে। অথচ সুজন হৃদয় হত্যা মামলায় ঘটনার ৬৭ মাস এবং মাদক মামলায় ৪০ মাস পর রায় হয়েছে।দুটি মামলায় বিচার বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে বরগুনার জেলা নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (স্পেশাল পিপি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ ট্রাইব্যুনালে বিচারক শুধু একজন। তিনি সকালে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষে দুপুরের দিকে শিশুদের মামলা শুনানি করেন। মামলার সংখ্যাও বেশি। সব আদালতের চিত্রই এমন। তাই কিছু করার নেই।’
সুপ্রিম কোর্টের গোপনীয় শাখার বিশেষ পরিসংখ্যানেও তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া যায়। এই শাখার তথ্যানুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে শিশুদের অপরাধ-সংক্রান্ত ২ হাজার ২৪৮টি মামলা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। সারাদেশে শিশুদের বিরুদ্ধে মোট বিচারাধীন রয়েছে ৩৯ হাজার ৩৫৮টি মামলা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিচারের ধীরগতির কারণে শিশুদের বিরুদ্ধে মামলার জট বাড়ছেই। এতে শিশু (কিশোর-কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রে বাড়তি সময় থাকতে হচ্ছে আটক শিশুদের। আবার যারা জামিনে মুক্ত রয়েছে, বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় তারাও হয়রানির পাশাপাশি নানা হতাশায় ভুগছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারের ধীরগতির জন্য পুলিশের গাফিলতি ও আদালতের বিচার কাঠামোও অনেকাংশে দায়ী। বিচারক সংকট, সাক্ষী গরহাজিরসহ নানা কারণে এ-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না।আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ বিষয়ে বলেন, শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য বিদ্যমান আইনে যেসব পরিবর্তন প্রয়োজন, সরকার তা গ্রহণ করবে। যেসব সমস্যা এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি চলমান রয়েছে।সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শিশু আদালতে বিচারাধীন ছিল ১৪ হাজার ৩৩টি মামলা। চার বছরের ব্যবধানে এখন তা ৪০ হাজারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২৮টি মামলার বিচার স্থগিত রয়েছে। গত পাঁচ বছরে শিশু আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতার দায় কার– এমন প্রশ্নে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘মামলার বিচারের ধীরগতির জন্য ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত দুর্বলতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অর্থাৎ পুলিশও দায়ী। কারণ নারী ও শিশু-সংক্রান্ত মামলাগুলো রাষ্ট্র বনাম অভিযুক্তের হয়ে থাকে। এ জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে পুলিশকেই মামলার বিচারের জন্য তদন্ত, অভিযোগপত্র দাখিল এবং সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পালন করে না। এ কারণে বিচারের ধীরগতি দেখা দেয়।তাঁর মতে, দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতির জন্য অবশ্যই আইনের আওতায় সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে বিচারে গতি আসবে।
মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের ৬৪ জেলার ১০২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে শিশু অপরাধ-সংক্রান্ত মামলার বিচার চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৭০৭টি শিশু অপরাধের মামলা ঢাকার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। ঢাকায় এসব মামলা বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি, ৯টি। এর পর উল্লেখযোগ্য মামলা বিচারাধীন রয়েছে চট্টগ্রামে ২ হাজার ১৫৫, রাজশাহীতে ১ হাজার ৮৭০, কক্সবাজারে ১ হাজার ৪৩৮, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৩৩৮, গাজীপুরে ১ হাজার ৩১০, বরিশালে ১ হাজার ১১৩, রংপুরে ১ হাজার ৪৬ এবং নেত্রকোনায় ৯১০টি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আদালতের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশের ৬৪ জেলায় এ ধরনের ৯৩০টি মামলা দায়ের হয়েছে। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ২৯১টি মামলা। অর্থাৎ তিন মাসে গড়ে ২২টির বেশি মামলা প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয়। এ সময় উল্লেখযোগ্য মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বরিশালে ১৫৬, কিশোরগঞ্জে ১৩৭, খুলনায় ১৩৫, কুষ্টিয়ায় ১২৭, ঢাকায় ১১৩, কুমিল্লায় ১০৯ এবং নেত্রকোনায় ৫২টি।
বিশেষজ্ঞ মত
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এস এম রেজাউল করিম বলেন, ‘শিশু আইনের সুফল অপরাধের সংস্পর্শে আসা শিশুরা পাচ্ছে না। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্য নিয়ে আইনটি করা হয়েছে, সেটি নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সবার চোখের সামনেই হচ্ছে। এটি পুরো সিস্টেমের ত্রুটি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ হওয়া উচিত। বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ– সবারই সহযোগিতা দরকার।’
২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণীত হওয়ার সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগের আইনটি বাতিল করে ২০১৩ সালে শিশু আইনটি করা হয়। আইটি পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ আইনে সমস্যা নেই, যেটা আছে সেটা প্রয়োগে। কেন আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার হচ্ছে না– সেগুলো নিয়ে কেউ বলছে না। নতুন আইন করা হলেও একই সমস্যা থেকে যাবে। তাই আইনের বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন।’ তাঁর মতে, যথাসময়ে বিচার হলে শিশুদের বিচারিক হয়রানি অনেকাংশে কমে আসবে।বাংলা একাডেমির সভাপতি ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, শিশুদের অপরাধের সময় বিবেচনা করে শিশু আইন সাজাতে হবে। অপরাধ শিশু বয়সের, আর সাজা ভোগ করবে প্রাপ্ত বয়সে–এটি হওয়া উচিত নয়। তাহলে আইনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত। নয়তো এসব শিশু সংশোধন না হয়ে অপরাধী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। এটা সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য সুখকর নয়।