বিশেষ প্রতিনিধি প্রকৃতি এখন শীতের বার্তা দিচ্ছে। দিনভর আবহাওয়া কিছুটা গরম থাকলেও বিকেল থেকে সকাল পর্যন্ত ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশায়। শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে হাসপাতালে বাড়ছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। হঠাৎ শীতজনিত রোগ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে শিশুদের স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় বিভিন্ন জেলায় ডিএনএস বা শিরায় দেওয়া স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়। সেই সংকট নিরসনে গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিশুদের স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ রেখে শুধু ডিএনএস উৎপাদনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ না থাকায় হঠাৎ করেই এমন সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট নিরসনে রোববার থেকে শিশুদের স্যালাইন উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়েছে অধিদপ্তর। অগ্রাধিকারভিত্তিক স্যালাইন সরবরাহের তাগিদও দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নেয় চট্টগ্রাম বিভাগের হাসপাতালগুলোয়। নভেম্বরের ১৯ দিনে চট্টগ্রাম বিভাগে ৯ হাজার ২৬৭ জন, রাজশাহীতে ৬ হাজার ৭৯৫, ঢাকায় ৪ হাজার ৩৫৮, খুলনায় ৪ হাজার ২৪৪, রংপুর বিভাগে ২ হাজার ৩৯৫, সিলেটে ২ হাজার ২৫০, বরিশালে ২ হাজার ২৪ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২ হাজার ৮১২ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সর্বোচ্চ রোগী চট্টগ্রাম বিভাগে থাকলেও শিশুদের স্যালাইন সংকট বেশি রাজশাহী বিভাগে।চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের কয়েকটি উপজেলার হাসপাতালগুলোয় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) এবং নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। মূলত শীতের আগমন, পানীয় জলের সমস্যা ও ওয়াসার পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে ধারণা করছেন তারা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস ও ডায়রিয়া রোগীর চাপ তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই নিউমোনিয়া রোগী।চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াস হোসেন বলেন, প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ জন ডায়রিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ সংখ্যা খুব বেশি নয়। ৫০০ থেকে ১ হাজার হলে খুব বেশি বলা যেত। তা ছাড়া আমাদের এখানে স্যালাইনের কোনো সংকট নেই। মজুত স্যালাইন দিয়েই দু-তিন মাস চলবে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০০ রোগী ভর্তি থাকছে। হাসপাতালের ২২ বেডের নিউমোনিয়া ইউনিটে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছে ৯০ শিশু।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন তিন গুণ বেশি শিশু রোগী ভর্তি আছে। শিশুদের নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়া অনেক বেড়েছে। পাঁচটি শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে স্যালাইনের সংকট হচ্ছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য এপিএন স্যালাইনের ৫০০ এমএল, ১০০০ এমএল, ডিএনএস-১০ প্রয়োজন হয়। আমাদের স্টকে এই স্যালাইনের ঘাটতি রয়েছে। এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের কাছে স্যালাইনের চাহিদা জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। তবে এখনও উত্তর পাইনি।এদিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা। এক সপ্তাহ আগে শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩০ জন এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচজন ভর্তি হয়েছিল। এর পর থেকে প্রতিদিন নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। গতকাল হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫৯ জন এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১০ জন ভর্তি হয়েছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫ শিশু হাসপাতালটির আইসিইউতে ভর্তি আছে।
জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) উপপরিচালক ও মুখপাত্র নূরুল আলম বলেন, গত কয়েক মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় স্যালাইন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ডিএনএস স্যালাইন উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে কারণে শিশুদের স্যালাইন উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে। এ কারণে হঠাৎ ডায়ারিয়া ও নিউমোনিয়া রোগী বেড়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে।তিনি আরও বলেন, বেবি স্যালাইন সংকট নিরসনে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আজ (রোববার) বৈঠক হয়েছে। সেখানে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত বেবি স্যালাইন উৎপাদনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাজশাহী বিভাগে স্যালাইন সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, দু-তিন দিনের মধ্যে শিশুদের স্যালাইনের সংকট কেটে যাবে। হঠাৎ সংকট কেন– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রকোপের কারণে বেবি স্যালাইন উৎপাদন বন্ধের জন্য এ সংকট। ঔষধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এক্মি ল্যাবরেটরিজ, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ওরিয়ন ইনফিউশন, অপসোনিন ফার্মা ও লিবরা ফার্মাসিউটিক্যালস মিলে দৈনিক ১ লাখ ৯০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করতে পারে। গত ১৫ দিনে শুধু রাজশাহীতে ২ লাখ ২২ হাজার ৯৩৮ ব্যাগ স্যালাইন ঔষধ প্রশাসন থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।