• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৪ অপরাহ্ন |
  • Bangla Version
নিউজ হেডলাইন :
করোনা শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের বেশি, মৃত্যু ১ ফের আগ্রাসনের চেষ্টা করলে ইসরায়েলকে শক্তিশালী জবাবের হুঁশিয়ার ইরানের গাজায় এক গণকবরেই মিলল ৩০০ লাশ ইসরায়েলের গভীরে হামলার দাবি হিজবুল্লাহর বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক দুর্নীতির একটা সীমা থাকে, এটা সাগরচুরি বেনজীরের দুর্নীতির অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট প্রভাবমুক্ত থেকে দুদককে অনুসন্ধান করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাতারের আমিরের বৈঠক কাতারের সঙ্গে পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই রেয়াত সুবিধা বাতিল, ঢাকা থেকে ১৫ রুটে যত বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া চলমান তাপপ্রবাহ আরো কতদিন থাকবে, যা জানা গেল রংধনুর রফিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক বেনজীরের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান, অগ্রগতির প্রতিবেদন চেয়েছেন হাইকোর্ট পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন : হাইকোর্ট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের তফসিল ঘোষণা

চলে গেলেন সুরসম্রাজ্ঞী

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্য
কে পাচ্ছেন লতার শত শত কোটি টাকা?
মঞ্চে নয় বছর বয়সে, ফিল্মে অভিনয় তেরো বছরে
আমার সৌভাগ্য যে উনার সামনে গাইতে পেরেছিলাম: সাবিনা ইয়াসমিন

ডেস্ক রিপোর্ট : শেষ হলো কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের ৯২ বছরের পথচলা। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর হেরে গেলে উপমহাদেশের এই সুরের সরস্বতী। রোববার সকালে মধ্য মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমসসহ বেশ কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম খবরটি নিশ্চিত করেছে।
এর আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হন লতা মঙ্গেশকর। ৮ জানুয়ারি থেকে ভর্তি ছিলেন মুম্বাইয়ের ওই হাসপাতালে। ছিলেন আইসিইউতেও।
প্রথমে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন লতা। একসময় কোভিড নেগেটিভ হলেও পরে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে তার। চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন। সম্প্রতি তার শারীরিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে শনিবার লতার শারীরিক পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়। এদিন দুপুরে চিকিৎসকেরা জানান, গায়িকার অবস্থা সঙ্কটে। চিকিৎসকেরাও চেষ্টা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে যান কিংবদন্তিতুল্য এ শিল্পী।
লতার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকে কাতর হয়ে পড়েছে ভারতসহ এ উপমহাদেশের বিভিন্ন মহল। বিনোদনজগতের সঙ্গে লতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এক নজরে লতা মঙ্গেশকর : জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ইন্দোরে। বাবা প-িত দীনানাথ মঙ্গেশকর একজন মারাঠি ও কোঙ্কিণী সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা ছিলেন। মা শেবন্তী (পরে নাম পরিবর্তন করে সুধামতি রাখেন) বোম্বে প্রেসিডেন্সির তালনারের (বর্তমান উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্র) একজন গুজরাতি নারী ছিলেন।
সংক্ষেপে কর্মজীবন: লতা ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন হয়েছিল ১৯৪২ সালে, মারাঠি গান গেয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য গান করেন। বসন্ত জোগলেকরের ‘আপ কি সেবা মে’ ছবিতে তিনি ‘পা লাগু কার জোরি’ গানটি গেয়েছিলেন। দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দার তাকে প্রথম বড়ো সুযোগ দেন।
‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিন মেরা তোরা’ গানটির পর লতাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ডের ইতিহাস আশা ভোসলের। তিনি গেয়েছেন প্রায় ১০ হাজার গান। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে এ রেকর্ডটি ছোট বোন আশার হওয়ার আগে ছিল লতা মঙ্গেশকরের। লতা গেয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার গান। লতা মঙ্গেশকর প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। এর মধ্যে আছে বাংলাও। ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বেলে’সহ আরও অনেক বিখ্যাত বাংলা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি: লতা মঙ্গেশকর কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরতœ (২০০১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ (১৯৯৯), তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে (১৯৬৯) ভূষিত হয়েছেন। এই সঙ্গীতশিল্পীকে ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করেছে। এছাড়া তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯), এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী কালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।

মঞ্চে নয় বছর বয়সে, ফিল্মে অভিনয় তেরো বছরে : ভারতীয় কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মরাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের পর থেকেই মঙ্গেশকর পরিবারের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। তার বাবা তাকে লক্ষ্মী বলেই ডাকতেন। তার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন নাট্য অভিনেতা ও গায়ক। বাবার কাছ থেকেই তার সংগীতে প্রথম তালিম নেয়া।
ভারতের জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লতাকে প্রথম হেমা বলে ডাকা হতো। আগের নাম হেমা থাকলেও, বাবার ভাব বন্ধন নাটকের লতিকার চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে হেমার নাম বদল করে রাখা হয় লতা। যে নাম পরে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। ভারতরতœ হয়েছেন। জীবিত অবস্থাতেই তার নামে পুরস্কার দেয়া হতো।
মুম্বাইয়ের পেডার রোডের বাড়িতে, তিনটে ল্যান্ডলাইনের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বসাথে যোগ রেখে গেছেন ভারতের সুরসম্রাজ্ঞী।
কাজের মাঝেই নিজের ধ্যানজ্ঞান রেখেছিলেন। যে কাজ গান গাওয়া। তার প্রথম হিন্দি ছবি মহল এর আয়েগা আনেওয়ালার ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে। গানের বাইরে কোনো কিছুতে জড়াননি তিনি।
ছোটবেলা থেকেই জীবনযুদ্ধ। অর্থের তাগিদেই ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছিল। ফিল্মে অভিনয় তেরো বছর বয়সে।
অভিনয় প্রসঙ্গ এলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে লতা মঙ্গেশকর বলতেন, ওই মেকআপ আলো লোকজন গ্ল্যামার একদম ভালো লাগেনি আমার! তাই আর অভিনয় করার কথা ভাবিনি।
জীবনে প্রথম যখন বাবার সঙ্গে মঞ্চে উঠেছিলেন তখন বয়স মাত্র ৯ বছর। অনেকবার বলেছেন, বহুত তকলিফ উঠায়ি হ্যয় ম্যয়নে।
অবশ্য জীবনে সাফল্যের পর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ট্রাগল তাকে লতা মঙ্গেশকর তৈরি করেছে।
মাটি থেকে উঠে আসা আর মাটির সঙ্গে লেগে থাকা তারারাই সত্যিকারের আর্টিস্ট বলে মনে করতেন তিনি।
তার কাছে যেমন ছিল শচিন টেন্ডুলকার বা অমিতাভ বচ্চন। আকাশ ছুঁয়েও যারা মাটির কাছে থাকেন।
ছোটবেলা থেকেই লতা মঙ্গেশকরের অন্ধ ভক্ত শচিন টেন্ডুলকার। দেশে-বিদেশে সব সময়ই তার সঙ্গী লতাজির গান। তাই নিজের বাড়ির মিউজিক রুমের জন্য লতা মঙ্গেশকরের ব্যবহার করা কোনো জিনিস চেয়েছিলেন শচিন। শচিনের ইচ্ছা মতো, নিজের হাতের লেখা দুটো গান তার হাতে তুলে দেন লতা।
বাবার নাটক লেখা, বাড়িতে গানের ক্লাস, লোকজন- এসব দেখতে দেখতে তৈরি হয়েছেন লতা। প্রথমদিন স্কুলে গিয়েই অন্য বাচ্চাদের গান শিখিয়েছিলেন। সে কারণে শিক্ষকের কাছে বকা খাওয়ায়, পরের দিন থেকে স্কুল যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
তার বাবার নট্টকোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে তারা চলে আসেন পুনেতে। বাবাই ছিলেন তার পরিবারের বটবৃক্ষ। হঠাৎ সে বাবা চলে গেলেন। লতার বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। আছে আশা, ঊষা, মিনা আর হৃদয়নাথ। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে।
পয়সাও সংসারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ল। কাজে মনপ্রাণ বসিয়ে দিলেন লতা। তবে তিনি শোক আগলে বসে থাকেননি। মাঠে নামলেন লড়াই করতে। সাহায্য পেলেন বিনায়ক দামোদর কর্নাটকির, যিনি ছিলেন নবযুগ চিত্রপট ফিল্ম কোম্পানির মালিক।
১৯৪২ সালে মরাঠি ছবি কিতী হসাল-এ প্রথম গান রেকর্ড করেন লতা। ১৯৪৫-এ নবযুগ চিত্রপট মুম্বাই পাড়ি দেয়।
তার প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা। প্রথমবার মঞ্চে গাওয়ার জন্য লতা ওই ২৫ টাকা পান।
এরপর লতা আসেন আরব সাগরের পাড়ে তার সুরের আসন নিয়ে। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে শুরু করেন উস্তাদ আমন আলি খানের কাছে।
বিনায়কের মৃত্যুর পর গুলাম হায়দার লতার দায়িত্ব নেন। তিনি লতাকে আলাপ করিয়ে দেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শশধর মুখোপাধ্যায় লতার গলার স্বর শুনে বলেছিলেন, বড্ড সরু গলা।
কিন্তু হায়দার জানতেন, এমন এক দিন আসবে যখন সবাই এই লতার পায়ে পড়ে থাকবে গান রেকর্ডিং এর জন্য।
হায়দারের মজবুর ছবিতে ১৯৪৮-এ গান রেকর্ড করেন লতা। এরপর আরো সুযোগ এলেও, তখনো সঙ্গে ছিল সমালোচনা। বলা হতো নুরজাহানকে নকল করেন লতা।
দিলীপ কুমার লতার উর্দু অ্যাকসেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন লতা জানতেন সমালোচনা শুনতে। উর্দু শিখতে শুরু করেন তিনি। অবশেষে ১৯৪৯-এ হিট হয় আয়েগা আনেওয়ালা। সেখান থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
পঞ্চাশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত, বিশ্ব সংগীতের জমি লতার কণ্ঠকে জড়িয়ে আছে। অনিল বিশ্বাস থেকে শচীন দেববর্মণ, খৈয়াম, নৌসদ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কল্যাণজি-আনন্দজি, রামচন্দ্রমের মতো অগুনতি পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন লতা।
তার কণ্ঠ মাধুরীর নেশা ছড়াতে থাকে দেশময়, বিশ্বময়। শুধু হিন্দি ছবির গান নয়। গীত-গজল-ভজন- অ্যায় মেরে ওয়াতেন কে লোগোর মতো দেশাত্মবোধক গানে ভারতকে মনখারাপে ভিজিয়ে রাখেন তিনি।
ষাটের দশকে লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের ঘরানায় লতার সুরবিহার দেশ রাগ কালকে ছাপিয়ে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সাতশো গান রেকর্ড করেন লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের সঙ্গে।
শোনা যায় লতাকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টাও হয়েছিল। তিন মাস অসুস্থ ছিলেন তিনি। তার গলার রোম্যান্টিকতা আজো ভারতীয় রোম্যান্সের শেষ কথা।
যতীন মিশ্রর বই লতা সুর গাথাতে লতা বলেছেন, প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি, আর ভীষণ খিদে পেত আমার। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকত। নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে। সারা দিনে এক কাপ চা আর দু-চারটে বিস্কুট খেয়েই কেটে যেত। এমনও দিন গেছে, যে দিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারা ক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত- যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।
১৯৬৩ সাল। ভারত-চিন যুদ্ধে লিপ্ত। জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন, ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বয়ং।
কণ্ঠ দিয়ে জাতিকে এক করে দিতে পারতেন তিনি। কার্গিলের যুদ্ধেও সেনাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বেজেছিল লতার সেই গান। আজো ভারতের মতো ভিন্ন ভিন্ন ভাষার রাষ্ট্রে ২৬ জানুয়ারি মানে লতার এই গান।
১৯৭৮ সাল। ভারতের নাইটেঙ্গলকে নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন স্বয়ং রাজ কপূর। তার মেয়ে ঋতু নন্দার বইতে উল্লেখ আছে সেই ঘটনার। লতা অভিনয় করেননি। গান গেয়েছিলেন সত্যম শিবম সুন্দরম। শুধু হিন্দি নয়, আরো পঁয়ত্রিশটা ভাষায় অন্তত হাজার খানেক গান রেকর্ড করেছেন লতা। অভিনয়ের লোভ তাকে কাবু করতে পারেনি।
১৯৭৫ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে ছয় হাজার মানুষের সামনে লতা মঙ্গেশকরকে প্রথম নিয়ে আসেন মুকেশ। লতার উপর মোহন দেওরা আর রচনা শাহের রচনা থেকে জানা যায়, খালি পায়ে, সাদা বেগুনি পাড়ের সাধারণ শাড়ি আর নিজের হাতে লেখা গানের কাগজ নিয়ে মঞ্চে এসেছিলেন লতা। যেন এক সাধারণ মেয়ে। ততো দিনে হিন্দি ছবির তাবড় নায়িকাদের লিপে তার গান। রেডিও, টেলিভিশনে ঝরে পড়ছে মুক্তদানার মতো সুর।
মান্না দে বলেছেন, যে যত ভালই গাক। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন। ওর মতো কেউ গাইতে পারবে না। মান্নাদার সঙ্গে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, মঙ্গেশকর পরিবার মান্না দে-কে বড় দাদার মতো মানতেন।
নব্বইয়ের দশকে সিনেমার ক্যানভাস বদলালেও লতা রইলেন স্বমহিমায়। নদিম-শ্রবণ থেকে এ আর রহমান, তার আগে আর ডি বর্মণ- কেউ বাদ দেয়ার স্পর্ধা দেখাননি লতাকে। প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পীকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান অফিসার দে লা লিজিয়ঁ দ্য নর প্রদান করেছিল সেদেশের সরকার।
রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর লতার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বলতেন, লতা গলার ব্যাপারে এত পারফেকশনিস্ট যে, ভালবাসলেও আইসক্রিম ছুঁয়ে দেখে না।
জানা যায়, ভরপেট খাওয়া বা আইসক্রিম কোনোটাই গলার জন্য খেতেন না লতা। শোনা যায় রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গে গভীর বন্ধুতার সুবাদেই লতা এত ক্রিকেটপাগল হয়ে উঠেছিলেন।
বাংলা ছিল তার ভালবাসার জায়গা। কিশোরকুমার আর হেমন্তদা ছিলেন তার রাখি ভাইয়া। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে যাবতীয় গসিপ উড়িয়ে দিয়েছিলেন সুর সম্রাজ্ঞী।
হেমন্ত কন্যা রাণুকে নিজের হাতে সাধ খাইয়েছিলেন। বাংলায় বিবেকানন্দকে নিয়ে গান রেকর্ড করার প্রবল ইচ্ছে ছিল তার। সরস্বতীর ইচ্ছেও বুঝি আটকে রাখে সময়! তা হলে কী পরজন্ম?
সলিল চৌধুরীর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, সলিলদা যোগ্যতা অনুযায়ী কিছুই পেল না।
ভারতের সর্বকালের সেরা এই গায়িকা নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই ভালবাসতেন। পা অবধি লম্বা চুল। পা অবধি বিনুনি। হঠাৎ কেউ দেখে ফেলতেন বাড়ি গেলে। খোঁপা, ঘোমটা, শাড়ি… আমিকে আগলে রাখার আত্মবিশ্বাস ছিল তার মধ্যে।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, অমিতাভ বচ্চন বা শচিনকে কি চিৎকার করে বলতে হয় আমি অমিতাভ। আমি শচিন।আমায় দেখ।
অনেকেই জানেন না, ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন তিনি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বার বার যখন আনন্দ ঘন নামের কাউকে ডাকা হচ্ছিল, ডকুমেন্ট বলছিল তিনি এখানে উপস্থিত, কিন্তু কেউ পুরস্কার নিতে উঠছিল না স্টেজে। অবশেষে লতা উঠে পুরস্কার নেন। মারাঠি চলচ্চিত্রের রহস্যময় সঙ্গীত পরিচালক আনন্দ ঘন এর রহস্য এভাবেই সবার সামনে আসে।
এক অখ-ধার রাগের আলাপ ধুন- এসবের দেশ নেই। ভাষা নেই। তা বয়ে চলে কালের যাত্রায়। এই যাত্রার নাম লতা মঙ্গেশকর। নীরব আত্মার বিপ্লব। বিশ্ব সংগীতের সব জাতি তার কাছে ঋণী। তিনিই পারেন শিল্প, দর্শন, চিত্রকলা, সিনেমা, নাটক, কবিতাকে তার সুরে জাগিয়ে দিতে। এই ঋণ চুকিয়ে দেয়ার নয়। যে সময়ে তিনি এসেছিলেন সেই সময়ের সমগ্র মানব সভ্যতা তার ঋণ নত হয়ে স্বীকার করছে।
লতা মঙ্গেশকর। এক নীরব আত্মা। সরস্বতী। সরস্বতীর সৎকার হয় না!

আমার সৌভাগ্য যে উনার সামনে গাইতে পেরেছিলাম: সাবিনা ইয়াসমিন: উপমহাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে শুধু ভারত নয়, শোকের ছায়া নেমেছে দুনিয়াজুড়ে। নক্ষত্রপতনে শোকস্তব্ধ দুনিয়া। বাংলা তো বটেই, বাংলাদেশের সিনেমাতেও গেয়েছেন এই কিংবদন্তি। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো এই দেশের অনেক শিল্পীদের। ছিল অন্তরঙ্গতাও। তেমনই একজন সাবিনা ইয়াসমিন। লতা মঙ্গেশকরকে যিনি গানের স্বরসতী হিসেবেই মানেন।
লতার সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে হয় সাবিনা ইয়াসমিন গণমাধ্যমে বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে ১৯৭৮ সালে বোম্বেতে দেখা হয়েছিল। আমরা একটা ফেস্টিভালে বোম্বে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য যে উনার সামনে গাইতে পেরেছিলাম। উনার সঙ্গে ছবি আছে। সেটা বের করে সকাল থেকেই দেখছিলাম। সেই সফরে আমি ববিতা, রাজ্জাক, রোজী সিদ্দিকী ছিলাম। সেখানে ছিলেন শচীন দেববর্মন। তিনি বার বার বলছিলেন, ‘অনেকদিন বাংলা গান শুনি না। কতদিন বাংলা গান শুনি না। তুই একটা গান গা।’ তখন আমি ‘পাল তুলে দে’ গানটি গাইলাম। উনি কাঁদলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
তখন দেখি হঠাৎ লতাজি আসছেন। আমি হারমোনিয়াম ছেড়ে অন্যদিকে পালিয়ে গেলাম। কিন্তু আমাকে আবার ডাকা হলো। বলা হলো, গান গাইতেই হবে। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’ গাইলাম। লতাজি এতো প্রশংসা করলেন! আমি বললাম, ছোটবেলায় আপনার গান শুনে বড় হয়েছি। সত্যি বলতে, এখনও প্রতিদিন উনার গান শুনি।’’
লতাকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, ‘বলার মতো ভাষা নেই। সকাল থেকেই মুড অফ। কান্নাকাটি করেছি। জানি পৃথিবীর নিয়মে সবই চলবে। তিনি (লতা মঙ্গেশকর) চলে গেলেন। কিন্তু আমার মনে সবসময় একটা চিন্তা ভর করতো, ভাবতাম, তিনি হয়তো কখনও যাবেন না। লতা মঙ্গেশকর ছাড়া একটা পৃথিবীতে- ভাবাই যায় না। আমি ভাগ্যবান, যে লতা জির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল। সেই মুহূর্তগুলো আজও আমার মনে ভর করে। এখন সেদিনের স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। এত বড় মাপের শিল্পী কিন্তু কাছে গিয়ে বোঝার উপায় নেই। একটা কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, যত বড় শিল্পী ছিলেন, মানুষ হিসেবে ছিলেন ততই বিনয়ী।’
বিগত ২৭ দিন ধরে করোনা, নিউমোনিয়ার সাথে লড়াই করে আজ (৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টা ১২ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্য : লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ ভারত। ৯২ বছরে বয়সী থেমে গেলো সুরের পথ চলা। তার মৃতুর খবর শোনা মাত্রই মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ছুটে আসেন অনেকে।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, বেলা সাড়ে ১২টা পর লতা মঙ্গেশকরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে প্রভুকুঞ্জের বাসভবনে। এরপর বিকাল ৪টার দিকে নেওয়া হবে মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে। সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টার দিকে শিবাজি পার্কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যের কথা।
কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। প্রিয় শিল্পীর চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন ভক্তরা। লতার চলে যাওয়ায় শোক বার্তায় ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে ভারতের সংস্কৃতি জগতে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হয়েছে জানিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয় বলেও মন্তব্য করেন।
কোভিড পরবর্তী জটিলতার কারণে মৃত্যু হল লতা মঙ্গেশকরের, জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিন সকাল সোয়া ৮টার দিকে প্রয়াত হন লতা মঙ্গেশকর।

কে পাচ্ছেন লতার শত শত কোটি টাকা? : জীবনে বহু মানুষ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। অনেকে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। তবে প্রেমকে নিজের জীবন থেকে দূরেই রেখেছিলেন কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। বিয়ে করেননি, হয়নি সেই অর্থে ঘর-সংসার। আর সেই কারণেই নেই লতার উত্তরসূরি।
অন্যদিকে, একেবারে আটপৌরে জীবনযাপন করতেন তিনি। অথচ ঈশ্বর তাকে কণ্ঠের সঙ্গে দিয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, লতার সম্পদের পরিমাণ ১৫ মিলিয়ন ডলার। যা ১১১ কোটি রুপির সমতুল্য। আর মাসে আয় করতেন প্রায় ৪০ লাখ টাকা। ছিল হোটেলসহ নানা ধরনের ব্যবসা।
অন্য একটি সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, সব মিলিয়ে লতার সম্পদ ৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, সন্তানহীন এই তারকার সম্পদগুলো কে পাচ্ছেন? তবে আপাতত তার উত্তর এখনও মেলেনি। দ্রুতই হয়তো জানা যাবে তার উইলগুলো। বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই মুখ খুলবেন তার আইনজীবী।
উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লতার জন্ম এক মারাঠি পরিবারে। বাবার হাত ধরেই গান ও অভিনয়ের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। ১৩-১৪ বছরে প্রথম গান গেয়েছিলেন মারাঠি ছবিতে। হিন্দিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘মজবুর’ সিনেমা দিয়ে। লতার সুরেলা কণ্ঠ সিনেমা ও গানে প্রাণ ঢেলে দিতো। নক্ষত্রপতনে তাই শোকস্তব্ধ দুনিয়া।
২৭ দিন ধরে করোনা, চলেছে নিউমোনিয়ার সঙ্গে লড়াই। ৯ জানুয়ারি লতার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। সেখানে অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছিল লতার। ৩০ জানুয়ারি তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ভেন্টিলেশন থেকে বের করেও নিয়ে আসা হয় সুরসম্রাজ্ঞীকে। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ১২ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published.