এস এম বদরুল আলমঃ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির কারখানায় গোপনে তৈরি হচ্ছে দেশের নামি অ্যালোপ্যাথিক কম্পানির ওষুধ। আটা, ময়দা, রাসায়নিকসহ বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ওষুধ। মিটফোর্ডকেন্দ্রিক একটি চক্রের মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতাদের কম দামে এসব ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৫ জুন পর্যন্ত ২০টি অভিযান চালিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ঢাকার বংশাল, মিটফোর্ড, কোতোয়ালি, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, খিলগাঁও, নিউ মার্কেট, বাবুবাজার, চকবাজার, মিরপুর ও সাভারে নকল ওষুধ তৈরির কার্যক্রম চলে। এ ছাড়া বরিশাল, পিরোজপুর, কুমিল্লা, বগুড়া, ভোলা ও চুয়াডাঙ্গায় ওয়েস্ট ফার্মাসিউটিক্যাল (আয়ু) কারখানায় নকল ওষুধ পাওয়া যায় এবং ওয়েস্ট ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানার মালিক গিয়াসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দেশের ২৬টি নামি ওষুধ কম্পানির ৪৩ ধরনের ২৮ লাখ ১২ হাজার ৬৯৬টি নকল ওষুধ জব্দ করেছে ডিবির লালবাগ বিভাগ। এই বিভাগ একে একে ১৭টি নকল ওষুধের আস্তানায় হানা দেয়। এর মধ্যে ছয়টি কারখানা, ৯টি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এবং দুটি নকল ওষুধের মোড়ক তৈরির প্রতিষ্ঠান। এসব অভিযানে ঢাকার পাঁচ থানায় ১৩টি মামলায় ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেশে আরো অর্ধশত কারখানায় গোপনে নকল ওষুধ তৈরি হচ্ছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা।
কুমিল্লার হিমালয় ল্যাবরেটরিজ নামের একটি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কম্পানির অনুমোদন আছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরিতে গোপনে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরি করা হচ্ছিল। ডিবির অভিযানে গত ৫ জুন প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোর্শেদ আলম শাওনসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চক্রটি ঢাকার সাভার ও মিটফোর্ডে মুজদ করে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যানটোনিক্স-২০, স্কয়ারের সেকলো-২০, দি একমি ল্যাবরেটরিজের মোনাস-১০, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্জেল ক্যাপসুল, অপসোনিন ফার্মার ফিনিক্স-২০, কুমুদিনী ফার্মার অ্যান্টিবায়োটিক দিজা, আমবে ফার্মাসিউটিক্যালসের মাইজি ৫০০, জেনিথের ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস এবং ব্রোনসন-ইউএসএর জিবি-৬০ নামের নকল ওষুধ বাজারজাত করছিল।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবির সাবেক প্রধান) এ কে এম হাফিজ আক্তার সম্প্রতি প্রতিবেদকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি যে ইউনানি আয়ুর্বেদিক কম্পানিগুলোর ওষুধ ট্যাবলেট ফরম্যাটে আসার পর নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রবণতা বেড়েছে। এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। আমরা বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিচ্ছি। নকল ওষুধের কারবারিদের অনেকে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। শাস্তি কঠোর হওয়া দরকার। আমাদের নজরদারি আছে। তথ্য পেলেই অভিযান হচ্ছে। ডিবির সূত্র জানায়, নকল কারবারিরা ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধও নকল করছে। ডিবির অভিযানে জব্দকৃত ২৬টি কম্পানির ওষুধের মধ্যে ন্যাচারাল ইউনানি লিমিটেড, মডার্ন হারবাল রিসার্চ ও সিটি ফুড প্রতিষ্ঠানের ওষুধও আছে।ডিবির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলায় ১০-১৫টি কম্পানি (ইউনানি) পেয়েছি, যারা নকল ওষুধ তৈরি করে। অভিযানে তাদের কারখানা বা আস্তানা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ প্রতিবেদকে বলেন, ‘নকল যারা করেছে তাদের নোটিশ দিয়ে প্রডাক্ট বন্ধ ও কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। নকল ওষুধের মোড়ক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়। তবে সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। এটি নিয়ন্ত্রণে প্রিন্টিং যারা করে তাদের ডেকেছি। ছোট কম্পানি বাইরে থেকে মোড়ক বানায়। এখানে লিস্ট করে নজরদারি করার চেষ্টা করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে লুৎফুল কবির বলেন, কেমিক্যাল ও কাপড়ের রং দিয়ে যদি ওষুধ বানানো হয়, তাহলে অবশ্যই সেটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হবে।