">
বিশেষ প্রতিনিধি মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সীমান্তে সহিংসতাসহ নানা সংকটের কথা তুলে ধরেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।সরকারি প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি জনসাধারণের জীবনযাত্রাকে ভীষণ কষ্টের সম্মুখীন করেছে। বিশেষ করে ডিম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, চিনি, বিভিন্ন শাকসবজির দাম ছিল চড়া। এ ছাড়া সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধনী, টিস্যুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেশ বেড়েছে। ডিম আমদানি করে দাম কমানো সম্ভব হলেও বাকি পণ্যের দাম এখনও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সমস্যার বিষয় হলো– কার্যকর মনিটরিংয়ের অনুপস্থিতিতে বাজারমূল্য কারসাজির ঘটনা স্থায়ী রূপ নেওয়ার পর্যায়ে এসেছে। একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা সাধারণত আর কমে না।কমিশন বলছে, আয়-উপার্জনের স্তরভেদে দ্রব্যমূল্য জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে থাকলে ন্যূনতম উপায়ে জীবনধারণ বাধাগ্রস্ত হয়, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত রোববার রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের কাছে কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিদ্যমান আইন। কমিশনকে আরও কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ‘প্যারিস নীতিমালা’র আলোকে আইন সংশোধন করা জরুরি।প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, বেআইনি আটক, সীমান্তে হত্যা, নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগ, শ্রমিক অসন্তোষ, রহস্যজনক নিখোঁজ, সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা কমিশনের নজরে এসেছে। পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। নির্বাচন-পূর্ব, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়টি সারা বছর ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু প্রসঙ্গে কমিশন মনে করে, এসব ঘটনা মারাত্মক অপরাধ ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং এটি বন্ধে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমীচীন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নারীদের অধিকারের সমতা প্রদানে সরকারের নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পরও সহিংসতা বন্ধ করা যায়নি। ধর্মীয় কুসংস্কার, পিতৃতান্ত্রিকতা, নারী বিদ্বেষ প্রভৃতি কারণে ২০২৩ সালেও নারীর প্রতি নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি শিশু নিপীড়নও কমেনি। শিশুদের একটি বড় অংশ এখনও অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। তারা স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, শিক্ষা, সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাচ্ছে না।সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশিদের হত্যার সংবাদে কমিশন গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে। এ বিষয়ে ২০২২ সালে ভারতের মানবাধিকার কমিশনের কাছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পত্র প্রেরণ করলেও এখনও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। কমিশন মনে করে, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো এবং কার্যকর করতে হবে।
কমিশনের আইনি দুর্বলতা
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ‘ক্রসফায়ার’, গুম, বিনাবিচারে আটক, হেফাজতে নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ রয়েছে। সমালোচনা হয়ে থাকে যে, মানবাধিকার কমিশন এসব গুরুতর অভিযোগ নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। এ ক্ষেত্রে কমিশনের পক্ষ থেকে আইনি দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, কখনও কখনও যুক্তি দেওয়া হয়, কমিশন সরকারি অন্য যে কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটলে শুধু প্রতিবেদন চাইতে পারে। কমিশনের নিজেদের তদন্ত করার সুযোগ নেই। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আইন অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে কমিশন।বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল প্রসঙ্গে কমিশনের চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছি। সেখানে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিয়ে বন্ধ করা, যৌন নির্যাতন, হয়রানি, স্বাস্থ্য বিভাগের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, অবহেলার কারণে মানুষের চরম ভোগান্তি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আমাদের কথা শুনেছেন এবং প্রতিবেদন দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
Leave a Reply