">
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সাংবিধানিক কাঠামোতে সংস্কারের লক্ষ্যে ১৯ দফার প্রস্তাব করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
দফাগুলো হলোঃ
১. সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রথম সুপারিশ হল, সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না হওয়া ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত করা ।
২. আমরা প্রস্তাব করতে চাই যে সংসদ সদস্যদের সংসদের নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোটদানের সুযোগ থাকবে। তবে, তারা সেটা করতে পারবে যখন দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভাজন দেখা যাবে এবং কমপক্ষে দলীয় সংসদ সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে সেভাবে পরিবর্তন করার প্রস্তাব করছি।
৩. ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দেখায়, যদি একজন ব্যক্তি যথেষ্ট দীর্ঘ সময়ের জন্য সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তবে সেই ব্যক্তি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা দেখান এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। এইভাবে, বিশ্বের অনেক দেশের সংবিধানে যে কোনও ব্যক্তির দ্বারা সর্বোচ্চ দু বার শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জন্যও একই পরামর্শ দিতে চাই। এই বিধানটি আমাদের সংশোধিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৪. আরও সংস্কারের প্রস্তাবগুলিতে যাওয়ার আগে, আমরা পরামর্শ দিতে চাই যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানগুলি পুনরায় চালু হবে।
৫. সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি, সর্বসম্মত প্রার্থী বিবেচিত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। ১৫ তম সংশোধনী বাতিল করার পরে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮। (খ)-তে, সে অনুযায়ী পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
৬. পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হলে ৭(ক) অনুচ্ছেদটি বাদ হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ৭(ক) যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত হয় না। সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদটিও বাতিল হবে। এটির ফলে বর্তমানে সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশকে অপরিবর্তনীয় করা হয়েছ। অর্থাৎ এ বিধানের ফলে কোন সংসদ ভবিষ্যতে কোন সংসদের ক্ষমতা খর্ব করছে বলা যায়, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৮ অনুযায়ী সংগঠন করার মৌলিক অধিকারের উপর সরকারের জনবিরোধী বিধিনিষেধ থাকবে না।
৭. রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং সংসদ সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে হওয়া উচিত। এর ফলে রাষ্ট্রপতি মোটামুটি সর্বসম্মত প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাষ্ট্রপতি নিয়োগের জন্য তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুচ্ছেদ ৪৮(ক) সংশোধন করতে হবে।
৮. রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের জন্য সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান প্রবর্তন করে স্থায়ীত্বের ঝুকি হ্রাস করার প্রস্তাব করছি। সেই অনুযায়ী সংবিধানের ৫২ নং ধারা সংশোধন করতে হবে।
৯. আমরা উক্ত অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) সংশোধনের নিম্নরূপ প্রস্তাব করতে চাই, “এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৬ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতিত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সকল দায়িত্ব পালনে, নির্ধারিত পদ্ধতি, যদি থাকে; অথবা নিজের বিবেক, বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী কার্য করিবেন, যদি কোন নির্ধারিত পদ্ধতি না থাকে।
১০. দুইজন ডেপুটি স্পিকারের বিধান থাকা উচিত, একজনকে অবশ্যই বিরোধী দল থেকে মনোনীত/নির্বাচিত হতে হবে। অনুচ্ছেদ-৭৪। (১) অনুযায়ী দুই ডেপুটি স্পিকারকে সরকারী দল এবং বিরোধী দল থেকে একজন করে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করছি।
১১. সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ১৯৭২ সালের মূল বিধান পুনরুদ্ধারকারী ষোড়শ সংশোধনী ইতিমধ্যে আপিল বিভাগ দ্বারা বাতিল করা হয়েছে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণের জন্য “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল” গঠন করা যেতে পারে।
প্রস্তাব করছি, একই “সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল” এর মাধ্যমে অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সদস্যদের অপসারন বিষয়ক কার্যাবলী পরিচালনা করা যেতে পারে।
১২. সংবিধানের অনুচ্ছেদ. ১০৯ এর অধীন অর্পিত কার্যাবলী পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করার জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ “সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়” থাকবে। একই সচিবালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের দাপ্তরিক কাজও পরিচালনা করা যেতে পারে। সংবিধানে এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১৩. অনুচ্ছেদ- ১১৬ সংবিধানের অনুচ্ছেদ- ১০৯ এর সাথে সাংঘর্ষিক এবং এটি অপ্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এবং বাদ দেওয়া যেতে পারে।
১৪. সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৫। (২) (গ) এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে।
আমরা প্রস্তাব করছি, প্রধান বিচারপতির দ্বারা নির্বাচিত সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ বিচারপতিদের একটি প্যানেল অনুসন্ধান কমিটি হিসাবে কাজ করবেন, তারা বিচারক নিয়োগের সুপারিশ প্রধান বিচারপতির নিকট পেশ করবেন। সুপারিশ সহ নিয়োগ চূড়ান্ত করার জন্য প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রপতির কাছে তা প্রেরণ করবেন; এভাবে আইনটি তৈরী করা যেতে পারে।
১৫. “সংসদ সদস্যদের একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে শুধুমাত্র মহিলা প্রার্থীদের দ্বারা পঞ্চাশটি (৫০) আসন পূরণ করা হবে”; সংবিধানের অনু”্ছদে ৬৫(৩) এ বর্ণিত বিষয়টি অক্ষত রেখে আমরা প্রস্তাব করতে চাই, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই তাদের মোট প্রার্থীর কমপক্ষে দশ শতাংশ (১০%) মহিলা প্রার্থী সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী দিতে হবে। এই মহিলা প্রার্থীরা অন্যান্য দলের পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিপরীতে প্রার্থী নির্বাচন করার সময়, দলের যে মহিলা প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচনে লড়েছিলেন কিন্তু জিততে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।
১৬. প্রস্তাব করছি, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান কমিশনারদের নিয়োগ দিবেন। তবে, নির্বাচন কমিশন( ইসি) সদস্যদের মনোনয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একটি “অনুসন্ধান কমিটি” গঠন করবেন। অনুসন্ধান কমিটিতে এক তৃতীয়াংশ সদস্যকে অবশ্যই বিরোধী দল থেকে মনোনীত করতে হবে। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারগণ নিয়োগ দান করবেন।
১৭. সংবিধানের অনুচ্ছেদ.- ১২৬ এ, নির্বাচনের সময় কোনো কর্মকর্তা ইসি-র নির্দেশনা না মানলে নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে। এ বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব করছি।
১৮. কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকবেনা। রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগসমূহ চুড়ান্ত করবেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি নিম্নোক্ত ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন।
(১) বিচার বিভাগ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, (অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত) দুইজন, (২) সংসদ, দুইজন সংসদ সদস্য (একজন সরকারি দল থেকে এবং অন্যজন বিরোধী দল থেকে) (৩) আমলাতন্ত্র (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা) থেকে একজন, (৪) সুশীল সমাজ থেকে দুজন প্রতিনিধি (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা) মোট সদস্য সংখ্যা -৭।
উপরোক্ত কমিটিকে প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার এবং তাদের সুপারিশ সহ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
১৯. দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন ইত্যাদির মতো অন্যান্য সমস্ত সাংবিধানিক সংস্থার জন্য এই নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নিম্নোক্ত ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন।
(১) বিচার বিভাগ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, (অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত) দুইজন, (২) সংসদ, দুইজন সংসদ সদস্য (একজন সরকারি দল থেকে এবং অন্যজন বিরোধী দল থেকে) (৩) আমলাতন্ত্র (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা) থেকে একজন, (৪) সুশীল সমাজ থেকে দুজন প্রতিনিধি (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা) মোট সদস্য সংখ্যা -৭।
উপরোক্ত কমিটিকে প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার এবং তাদের সুপারিশ সহ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
উপসংহার: উপরে আমরা আমাদের মতামত ও পরামর্শগুলি সংবিধানকে আরও জনবান্ধব করে তুলতে এবং একক ব্যক্তির বা প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করার জন্য প্রস্তাব আকারে পেশ করেছি ।
আমাদের প্রস্তাবগুলির লক্ষ্য হল সংসদকে প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যবস্থা সুপারিশ করা।
এছাড়াও, আমরা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি। এটি আমরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য, একজন ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রী সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একক কর্তৃত্ব নিয়ে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারী হয়ে না উঠেন, সেটি নিশ্চিত করা।
-সমাপ্ত-
Leave a Reply