">
বিশেষ প্রতিনিধি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি ও বিতরণ করা যাবে না বলে এমন বিধান রেখে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩ অনুমোদন দেয় সরকার। কেউ এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও ওষুধের দোকানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তবে আইন অনুমোদনের দুই মাস পার হলেও বাস্তবে প্রয়োগ নেই। অনেক দোকানি এই আইন পাসের বিষয়ে জানেনও না। গত দুই দিনে রাজধানীর ৫০টির বেশি ফার্মেসি ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অপব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বড় বিপদে ফেলতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষের সতর্ক হওয়া জরুরি। এই আইন বাস্তবায়নে ওষুধের দোকানি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিয়ম সভা করা হয়েছে।ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেনাবেচা বন্ধ এবং কারও কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে তথ্যসংবলিত রেজিস্ট্রারে সংক্ষরণ করার কথাও উল্লেখ রয়েছে আইনে। এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার কমাতে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিকের মোড়কে লালচিহ্ন ব্যবহারের নির্দেশ দেয় ঔষধ প্রশাসন। তবে সেই নির্দেশনাও কার্যকর হয়নি। বাস্তবে এই আইন বা নির্দেশনা মানছে না কেউই।এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ ২০২৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছরের মতো এ বছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ পালন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সম্মিলিতভাবে অণুজীব প্রতিরোধী সক্ষমতা নিশ্চিত করুন’। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (অকার্যকারিতা) সহনীয় মাত্রায় আনার জন্য সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা মো. আতাউল্লাহ, তার পাঁচ বছরের শিশু আতিয়া জান্নাত চার দিন ধরে জ্বর-কাশি ও ঠান্ডায় ভুগছে। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে নাপা সিরাপসহ একাধিক ওষুধ কিনে খাওয়ানোর পরও জ্বর কমেনি। পরে ওই ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কেনেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই সর্দি জ্বর সারতে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ‘ফিউরোটিল প্লাস’ বিক্রি করেন ওষুধ বিক্রেতা। শুধু আজিমপুর নয়– পুরান ঢাকা, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাবসহ অর্ধশতাধিক ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই দেশে দেদার বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। তবে এমন চিত্র সারাদেশেরই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চলতি বছর জুনে প্রকাশিত ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল স্টুওয়ার্ডশিপ প্রোগ্রামস ফর ইনফেকশন কন্ট্রোল ইন এ টারশিয়ারি কেয়ার হসপিটাল’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, এখানকার আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মাঝে ৫২ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স পাওয়া গেছে। হৃদরোগ, কিডনি, শিশু ও নবজাতক বিভাগের রোগীদের মাঝে এই হার ছিল ২১ দশমিক ৫ শতাংশ।গবেষণার নেতৃত্ব দেন ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ শুধু চিকিৎসকদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ পোলট্রি শিল্পে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রীতে বিশেষ করে মুরগির মাংসে এ জাতীয় ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত ৫৫ শতাংশ। মৎস্য, পশু ও পোলট্রি শিল্পে ১৯ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি খাতও এর আশঙ্কার আওতামুক্ত নয়। এসব খাবার খেয়ে মানুষের শরীর সহজেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের করা সমীক্ষার দেখা গেছে, দেশে করোনার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৫২ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন কোনো না কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছে। এর আগের বছর এই হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী বিভাগের ডিন এবিএম ফারুক বলেন, ২০১৬ সালে ওষুধ নীতিতে ওষুধ আইনের কথা বলা হয়েছিল। সেই আইন পাস হতেই সাত বছর সময় লাগল। কর্মকর্তাদের বেখেয়ালিতে ওষুধ আইন পাস হতে এত সময় লেগেছে। বাস্তবায়নেও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপপরিচালক মো. নূরুল আলম বলেন, সপ্তাহে এক দিন বাজার তদারকির জন্য ঔষধ প্রশাসন থেকে টিম পাঠানো হয়।ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইউসুফ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে প্রায় ৭০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পাতায়ই লাল রং ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা আরও বেশি হওয়া জরুরি।
Leave a Reply