‘সব জায়গায় সব ক্ষেত্রে আমরা বঞ্চিত। সমানতালে কাজ করেও পুরুষদের অর্ধেক মজুরি পাচ্ছি। আবার দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করার নিয়ম থাকলেও প্রায়ই আধা কিংবা এক ঘণ্টা বেশি কাজ করিয়ে নেন মালিকরা।’ অভিযোগের সুরে কথাগুলো বলে বাড়ির পথ ধরেন মুন্সিগঞ্জ আদিবাসীপাড়ার মন্দিরা রানী মুণ্ডা। দুই সন্তানের জননী এ নারী জানান, নারী হওয়ায় অনেক সময় তাদের কাজেও নিতে চান না মালিকরা।
নারীরা আজও অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার দাবি করে জেলেখালী গ্রামের লক্ষ্মী রানী জানান, কৃষিজমিতে দিনমজুরের কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে রান্না করতে হয়েছে। স্কুল থেকে দুই সন্তান ও কাজ থেকে ফেরা দিনমজুর স্বামীকে দুপুরের খাবার দিয়ে গৃহস্থালির কাজ গোছাতে বিকেল গড়িয়েছে। এরপর দুই কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি এনে গোসল করতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রাতটুকু বিশ্রামের পর সকাল হতেই আবার কাজের জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। হাড়ভাঙা এমন পরিশ্রমের পরও পরিবারে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ তার।
পঞ্চম শ্রেণি পাস এ নারী বলেন, ‘যদি লেখাপড়া শিখতি পারতাম, তবে হয়তোবা ছোটখাটো চাকরি করলি স্বামী বা শ্বশুরগো মন রাখতি গে এত খাটতি হতো না।’
শুধু মন্দিরা আর লক্ষ্মী রানী নন, বরং উপকূলীয় এ জনপদের নারীদের প্রায় সবারই দাবি, তারা অনেক বেশি অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার। মজুরি বৈষম্যের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ তাদের। শ্যামনগর উপজেলার কদমতলা গ্রামের আছিয়া বেগম, নমিতা রানীসহ কয়েক নারী শ্রমিক জানান, তারা পুরুষের সমান কাজ করে এক বেলার জন্য ২০০ টাকা পাচ্ছেন। অথচ পুরুষরা ৩০০ টাকা পাচ্ছেন।
নকিপুর বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার কাজে নিয়োজিত আছিয়া ও ফরিদা বিবি জানান, সকাল থেকে একই সময়ে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে কাজে যোগদান করেও তারা পাচ্ছেন ৪০০ টাকা। বিপরীতে পুরুষ শ্রমিকরা সাড়ে ৫০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রয়োজন ছাড়া নারী শ্রমিকদের কাজে নিতে চান না ঠিকাদারের লোকজন।
কর্মক্ষেত্র আর মজুরির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাসহ পারিবারিকভাবেও এ জনপদের নারী বৈষম্যের শিকার বলে জানান অনেকে। মুন্সিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সংযুক্তা, শ্যামলী, রাবেয়া, সুমাইয়াসহ অন্যরা বলেন, মেয়েরা এখনও ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন না। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পিতামাতা মেয়েদের বেশিদূর পর্যন্ত লেখাপড়া করান না। ছেলেসন্তানদের বিষয়ে তারা উল্টো মনোভাব দেখান। এ ছাড়া স্কুল-কলেজে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।
শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি, মীরগাং, গাবুরাসহ বিভিন্ন এলাকার নারীদের অভিযোগ, নারী অধিকার নিয়ে সভা-সমাবেশ হচ্ছে, নারী দিবস পালন হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও অদ্যাবধি নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কয়েক নারী অভিযোগ করেন, বাস কিংবা যানবাহনে চলাচল করতে গিয়ে এখনও পুরুষের টিপ্পনী ও কুদৃষ্টি মোকাবিলা করতে হয়। পারিবারিক ও সাংসারিক বিষয়গুলোতেও নারীদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে কয়েক নারী জানান, সন্তান জন্মদান আর লালনপালনের বাইরে পরিবারে তাদের কোনো গুরুত্ব নেই। উপযাজক হয়ে পারিবারিক বিষয়ে কথা বলতে গেলে কোনো কোনো সময় সহিংস আচরণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন কয়েক নারী।