বিশেষ প্রতিনিধি তাজবিরুল ইসলাম সবুজ (৩২)। শেখ শিমুল বলেও চিনে থাকে। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। কিন্তু তিনি নিজেকে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। আবার কখনও বিভিন্ন অখ্যাত গণমাধ্যমের সাংবাদিক দাবি করে আইডি কার্ডও দেখাতেন। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে একাধিক বিয়ে করেন। এরপর সেখান থেকে ঢাকায় এসে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আবারও এক নারীকে বিয়ে করেন।এবার ঢাকার নারীদের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করেন সবুজ। বিয়ের বছরখানেক পার হওয়ার পরেই নারীদের তালাক দিয়ে দিতেন। পরে বিভিন্ন সময়ে ধারণকৃত অশ্লীল ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন তিনি।পাশাপাশি সবুজের হাতে প্রতারিত নারীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে তিনি মোটা অংকের টাকাও আদায় করেছেন। এককথায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে নারীদের বিয়ে করা ছিল তার এক ধরনের নেশা। পাশাপাশি নারীদের অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে টাকা আদায় ছিল তার পেশা।তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সবুজের এক সাবেক স্ত্রী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগের পর তাকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গাজীপুর মহানগরীর গাছা এলাকা থেকে তাকে সোমবার মধ্যরাতে গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় তার কাছ থেকে দুটি ভুয়া সাংবাদিকের আইডি কার্ড, দুটি ভুয়া টিন সার্টিফিকেট, ১১টি ভুয়া প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ড, তিন ধরনের ভিজিটিং কার্ড, একটি স্পাই ক্যামেরা, সাতটি এটিএম কার্ড, ছয়টি চেক বই, একটি পে-অর্ডার, একটি বিয়ের হলফনামা, একটি ভুয়া জীবনবৃত্তান্ত ফরম, একটি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত বেল্ট, চারটি পেনড্রাইভ, দুটি মেমোরি কার্ড, ছয়টি মোবাইলফোন এবং ৪১টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়।র্যাব বলছে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে তিন বছর আগে ভুয়া কাজী দিয়ে এক নারীকে বিয়ে করেন সবুজ। বিয়ের পর ভুয়া সাংবাদিক সবুজ ওই নারীকে অচেতন হওয়ার ওষুধ খাইয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করে রাখেন। সম্প্রতি তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় ভিকটিম তাকে ডিভোর্স দেয়।এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সবুজ ক্যামেরায় ধারণকৃত এসব অশ্লীল ভিডিও বিভিন্ন ভুয়া ফেসবুক আইডি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। শুধু তাই নয়, ওই নারীর কাছে মোটা অংকের টাকাও দাবি করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে কারওয়ানবাজারে মিডিয়া সেন্টার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-১ সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল মোমেন।র্যাব কর্মকর্তা জানান, সবুজ গাজীপুরের সালনায় এলাকায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। পড়াশোনায় তিনি অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পার হতে না পারলেও নিজেকে একজন গ্র্যাজুয়েট হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি আব্দুল্লাহপুরে ‘দৈনিক আজকের আলোকিত সকাল’ নামের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের সংবাদকর্মী হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছিলেন। তিনি সাংবাদিকতার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন।এছাড়াও বিবাদমান দুই পক্ষের সাথে সাংবাদিক পরিচয়ে সমস্যা সমাধানের মধ্যস্থতা করার জন্য টাকা দাবি করতেন। বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সুসর্ম্পক রয়েছে দাবি করে আইনি সমস্যা সমাধান করে দেবেন বলেও টাকা নিতেন।পাশাপাশি আইনি জটিলতা আছে এমন কিংবা আদালতে বিচারাধীন জমি উদ্ধারের নাম করে বিবাদমান পক্ষের কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন। তার প্রতারণার কাজে ফজল, তোফাজ্জল, মাসুম, আলতাফসহ আরও ২/৩ জন তাকে সহযোগিতা করতো বলে জানা যায়।
আব্দুল মোমেন আরও জানান, প্রতারক সবুজ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ২০০৫ সালে তার নিজ এলাকায় প্রথম বিয়ে করেন। পরে তার প্রথম স্ত্রী এক বছর সংসার করে তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। পবরর্তী সময়ে ২০১২ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করলে তার সেই স্ত্রীও এক বছর সংসার করে তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। এরপর তিনি বাগেরহাট থেকে ঢাকায় চলে এসে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেন। ২০১৪ সালে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরির সুবাদে এক নারী কর্মীকে বিয়ে করেন।পরে ২০১৮ সালে উত্তরখান মাজার তালতলা এলাকায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করাকালে তার তৃতীয় স্ত্রী বর্তমান থাকাবস্থায় নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে সেখানে কর্মরত একজন গার্মেন্টস কর্মীর সাথে প্রেমের সর্ম্পক তৈরি করেন।
তিনি তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময় শারীরিক সর্ম্পক করেন এবং সেই দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে রাখেন। এরপর প্রতারক সবুজ একজন ভুয়া কাজী ডেকে কাবিননামা তৈরি করে এক নারীকে বিয়ে করেন। ওই নারীর সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বিভিন্ন ভিডিও তিনি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এরপর ২০২২ সালে এসে আবারও এক গার্মেন্টসকর্মীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন সবুজ। সেই নারীর সাথে একই কাজ করেন।র্যাব জানায়, বিভিন্ন নারীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করাই তার নেশা। এর পাশাপাশি বিয়ে করে নারীদের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন এই প্রতারক সবুজ। তার কাছ থেকে দুটি মেমোরি কার্ড ও চারটি পেন ড্রাইভ পাওয়া গেছে। সেই মেমোরি কার্ডে অনেক নারীর অশ্লীল ভিডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে, যেগুলো তিনি বিভিন্ন সময় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।