নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল।হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,মাওলানা ভাষানী সহ ততকালীন বাঙালী নেতারা পাকিস্থানের শোষন থেকে মুক্ত একটি মানচিত্র ও সার্বভৌম দেশের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসাবেই গড়ে ছিলেন পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী লীগ।জুন মাস আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার মাস। পচাত্তর পরবর্তীতে ৪র্থ বারের মত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে। এক নাগাড়ে ৩য় বারের মত রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার এই ১১ বছরে আওয়ামী লীগের আকাশ থেকে হারিয়ে গেছে কয়েকটি মহা তারকা।যাদের অভাব পূরণ সম্ভব নয়।
২০২০ সাল বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী পালন করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু মরণঘাতী করোনা সেই আয়োজনে বিরাট ছেদ করে দিয়েছে। আর খোদ জুন মাসেই আওয়ামী লীগের তিন জাতীয় নেতা পর পর দুই দিনে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এই সব মহামানবের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আব্দুর রাজ্জাকঃ শরীয়তপুরে জন্ম নেওয়া এই রাজনৈতিক ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হাতিয়ার। দেশপ্রেম,সংগ্রাম আর বিশ্বস্থতায় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর ও আদর্শের বাহক। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর হয়তো তাকেও হত্যা করা হত কারাগারে। ৭৫’র পরে সামরিক শাসকের চরম অত্যাচার সহ্য করেছেন। ধরে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর বাকশাল। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহ সরকারের গুরুত্ব পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাহক হিসাবে দেশ বিদেশে আব্দুর রাজ্জাকের অসংখ্য অনুরাগী রয়েছেন। তিনি ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর লন্ডনের কিংস হসপিটালে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন।
আব্দুল জলিলঃ আব্দুল জলিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এই নেতা উত্তর বঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একীভূত করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের প্রধান ছিলেন। নওগার ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের জন্ম নেওয়া আব্দুল জলিল লন্ডনে আইনের ছাত্র থাকা অবস্থায় আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে দেশে ফিরে আসেন। ৭৫’র এর পর সামরিক সরকারের সময় তিনি ৪ বছর জেল খাটেন। ৮০র দশক থেকে তিনি বিবিসি ও ভয়েস অফ অ্যামিরিকার রেডিও তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসাবে ব্রিফিং দিতেন। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্টএলিজাবেথ হাসপাতালে কিডনি সমস্যা নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুতেও আওয়ামী লীগে ব্যপক শূণ্যতা তৈরি হয়েছে।
সুরেঞ্জিত সেন গুপ্তঃ সুরেঞ্জিত সেন গুপ্ত ৮০’র দশকের পর আওয়ামী লীগের একজন অন্যতম নেতা এবং অবিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি যুবক বয়সে বাম রাজনৈতিক ধারা থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ছিলেন এবং নীতি নির্ধারণী নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে একজন সক্রীয় সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরেই তিনি ৭ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে তিনি ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন।
জিল্লুর রহমানঃ জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কয়েকবার দায়িত্ব পালন করেছেন। ১/১১ এর সময়ে তিনিই আওয়ামী লীগকে এক করে রেখেছিলেন সংস্কার পন্থীদের থেকে দলকে ইউনাইটেড করে নেত্রী মুক্তির আন্দোলন করে তাকে কারামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথেও একবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মূত্রথলির সমস্যা নিয়ে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীঃ এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর আরেকজন অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি নৌকায় করে ইট বালি এনে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর পাকা করেন। তিনি চট্টগ্রামের জনপ্রিয় নেতা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এই নেতা ৩ বার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন।
আব্দুল মান্নানঃ আব্দুল মান্নান বগুড়ার সাবেক সাংসদ। তিনিই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নেতা যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০১ সালের বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালীন। এই দুঃসময়ে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যপক জনপ্রিয়তা পান। বগুড়ার উন্নয়নে তার ব্যপক ভূমিকা রয়েছে। তিনি ছাত্রলীগ নেতা থাকা অবস্থায় জিয়া তাকে মন্ত্রিত্বের প্রলোভন দেখালেও তিনি তা প্রত্যাখান করেন এবং জিয়াকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে দেননি। এই নেতা তিনি ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারীতে ঢাকার একটি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
মোহাম্মদ নাসিমঃ মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় ৪ নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর যোগ্য ছেলে। তিনি নিজ যোগ্যতায় জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। সৈরাচার এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সৈর শাসনের বিরুদ্ধে তিনি রাজপথের সেনা নায়ক ছিলেন। তিনি আওয়ামী থেকে ৭ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হত এবং স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে ছাত্রলীগ,এর পর যুবলীগ ও ১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুব সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বাকশালেও গুরুত্ব পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০২০ সালের ১৩ জুন ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ ও করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগি সৈয়দ নজরুল ইসলামের যোগ্য সন্তান্ত। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২ মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।তিনি ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলামের তান্ডব দমন ও ১/১১ এর সময় শেখ হাসিনা মুক্তির পক্ষে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে এসে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সরকারের জনপ্রশাসন ও এলজিআরডি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ২ মেয়াদ। তার পরিছন্ন নীতি দল বেদল সর্বজন সমাদৃত। তিনি ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারী ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্তান্ত হয়ে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহঃ গোপালগঞ্জের এই রাজনীতিবিদ আইন,অর্থনীতি ছিলেন উচ্চতর ডিগ্রীধারী। তিনি কোরআনের হাফেজ ছিলেন। ৬৬ দফা আন্দোলনের সময় ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। এবং দেশ স্বাধীনের পর তিনি গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় সম্মেলন তিনি আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি হেফাজত ইসলামের সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পর্ক উন্নয়ন এবং কওমী মাদ্রাসার সনদ স্বীকৃতিতে তার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। তিনি হজ্বযাত্রীদের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের ২৩ জুন রাতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাস্পাতালে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি শেখ হাসিনার নির্বাচিত আসনে উন্নয়ন মূলক কাজের দেখা শোনা করতেন।
বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানঃ বদর উদ্দিন আহমদ কামরা সিলেটের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি ছাত্র থাকা অবস্থায় সিলেট পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন .১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২ বার সিলেট পৌর সভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র তিনি। তিনি ২০০৮ সালে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় সিলেট সিটির মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের সম্মেলনে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ১৪ জুন তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভোর রাতে মৃত্যু বরণ করেন।
এছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেক পরীক্ষিত নেতা মৃত্যু বরণ করেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক শোক বার্তায় বলেন দুঃসময়ে যাদের কাছে পেয়েছি এক সাথেই তাদের হারালাম। এবং তাদের মৃত্যু আওয়ামী লীগের জন্য মারাত্বক ক্ষতি বলে তিনি স্বীকার