চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে তিন মাসব্যাপী ত্রাণ সরবরাহ ও কর্মহীনদের মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ করতে হবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারকে আট দফা প্রস্তাব দিয়েছেন বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষক, চিকিৎসক, লেখক, গবেষক ও শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে গতকাল দুপুরে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
এ সময় সরকারের নেয়া পদক্ষেপের বিভিন্ন ত্রুটি, অবহেলা ও সংকট পরিস্থিতি বিশদ আকারে তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রস্তাবনা পাঠের পর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন-উত্তরের পাশাপাশি বর্তমান সংকট ও বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক ফিরোজ আহমেদ, উন্নয়ন ও অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা ও প্রকৌশলী ও গবেষক অনুপম সৈকত শান্ত। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সামিনা লুত্ফা।
লিখিত বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, আমরা লক্ষ করছি, যেসব দেশের সরকার করোনা মোকাবেলায় তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, দেশের নাগরিকদের ন্যূনতম খাদ্য আশ্রয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে ও যেসব দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দৃঢ় ভিত্তি আছে, এ সংকট মোকাবেলায় তারাই সাফল্য দেখিয়েছে। এ তিনটি ক্ষেত্রেই দুর্বলতা, শৈথিল্য, অমনোযোগ ও যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকার অভাবে বাংলাদেশ অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয় বিষয়গুলো নির্ধারণ করে তা দেশের সর্বস্তরের মানুষ ও সরকারের কাছে উপস্থাপন করছি।
মাহা মির্জা বলেন, মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান এ ন্যূনতম চাহিদাগুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে। অনেকে বলেন, আমাদের মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে এসব কিছু সম্ভব না। কিন্তু যদি আমরা কিছু মেগা প্রজেক্টের খরচ দেখি, তাহলে অবাক হয়ে যাব। অথচ আমরা আমাদের বাজেটের এক শতাংশেরও কম জনস্বাস্থ্য খাতে খরচ করি। আমরা যদি বাঁচতে চাই তাহলে ভবিষ্যতে অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করতে হবে।
কৃষকের যে ফসল নষ্ট হচ্ছে, সরকার তা কিনে নিয়ে অসহায় কর্মহীন ও দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করাই এখন অন্যতম জরুরি কাজ। তাদের আট দফা প্রস্তাবের মধ্যে কর্মহীন, মানুষদের (মজুর, বেকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী) ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী, নগদ অর্থ ও ত্রাণ পৌঁছানো। সব শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারী, পেশাজীবীদের বকেয়া পরিশোধ করতে হবে, ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে, ছুটিকালীন মজুরি দিতে হবে।
কোভিড-১৯সহ সব রোগের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। কভিড-১৯ চিকিৎসায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্বতন্ত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে, প্রতি জেলায় ল্যাব স্থাপন করে টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পিপিই দিতে হবে। আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউজগুলোয় তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সব কৃষক ও খামারির পণ্য বাজারজাত ও যুক্তিসংগত দামে পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে।
সরাসরি কৃষক ও খামারির কাছ থেকে সরকারের খাদ্যপণ্য কেনার পরিধি বাড়াতে হবে। কৃষককে স্বল্প সুদে দেয়া ঋণের পরিধি ও পরিমাণ বাড়াতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সরকার, ব্যাংক ও এনজিও প্রদত্ত ঋণের সব কিস্তি স্থগিত করতে হবে। মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে, বাজারে খাদ্যদ্রব্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।
মজুদদার, চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলতে হবে। সারা দেশের চাল চোর, ত্রাণ চোরদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও গবেষণা বাড়াতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন দর্শনে মৌলিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মুনাফামুখী তত্পরতা, জৌলুস ও ভবন, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ভোগবিলাসকে উন্নয়ন হিসেবে দেখা যাবে না। জনগণের জীবন ও নিরাপত্তাকেই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।