করোনায় মৃত্যু ৩৩
এখন যেসব মৃত্যু হচ্ছে, সেটা ডেফিনিটলি ওমিক্রনের প্রভাব। ওমিক্রনে মৃত্যু হচ্ছে। এখন তা কোথায় গিয়ে থামে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ওমিক্রন অন্য কোনও ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে কোনও অংশে কম না।
ডা. মুশতাক হোসেন, উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এবং গত ৫ মাসের মধ্যে করোনায় একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতর এ তথ্য জানা যায়। ওইদিন অধিদফতর জানায়, করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৩ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ ঠিক এক মাস আগে, গত ৮ জানুয়ারি করোনায় একজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল অধিদফতর।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যেসব মৃত্যু হচ্ছে তার অধিকাংশই ওমিক্রনের প্রভাবে। সেই সঙ্গে ডেল্টাও রয়েছে। তাছাড়া টিকা না নেওয়াটাও বড় কারণ। তারা বলছেন, মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা থাকবে আরও বেশ কিছুদিন। কারণ সংক্রমণের চূড়ায় যখন বাংলাদেশ গিয়েছিল তখন অনেকের অবস্থাই খারাপ হয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন অনেকে। মৃত্যু কমে আসা দেখা যাবে আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর।
গত এক সপ্তাহের মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যায়, ৭ ফেব্রুয়ারি ৩৮ জন, ৬ ফেব্রুয়ারি ২৯ জন, ৫ ফেব্রুয়ারি ৩৬ জন, ৪ ফেব্রুয়ারি ৩০ জন, ৩ ফেব্রুয়ারি ৩৩ জন, ২ ফেব্রুয়ারি ৩৬ জন আর ১ ফেব্রুয়ারি ৩১ জনের মৃত্যু হয় ।
প্রথম দিকে, ওমিক্রনে আক্রান্ত হবেন অনেকেই, তবে এতে ডেল্টার মতো জটিলতা নেই এবং একে মৃদু বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরেই করোনায় মৃত্যু বাড়তে দেখা যাচ্ছে। শুরু থেকেই জনস্বাস্থ্যবিদরা বলে আসছেন, টিকা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায় না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও আইসিইউ পর্যন্ত যাওয়ার হার কমাতে পারে, কমাতে পারে জটিলতা।
এদিকে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২২৬ জন। এর আগের সপ্তাহে (২৪ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি) মারা যান ১৪০ জন। অর্থাৎ আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে মৃত্যু বেড়েছে ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ।
আর যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৭১ শতাংশই করোনা প্রতিরোধক টিকা নেননি। মারা যাওয়া ২২৬ জনের মধ্যে টিকা নেয়নি ১৬১ জন, শতকরা হিসাবে ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। মৃতদের মধ্যে টিকা নিয়েছিল ৬৫ জন, যা ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, টিকা নেওয়ার পরও মারা যাওয়া ৬৫ জনের মধ্যে ২৫ জন টিকার প্রথম ডোজ এবং ৪০ জন দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউই টিকার বুস্টার ডোজ নেয়নি।
অধিদফতর জানাচ্ছে, মারা যাওয়াদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল ৬৮ শতাংশের বেশি মানুষ। অধিদফতর জানায়, ২২৬ জনের মধ্যে ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল। এছাড়া ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ ডায়াবেটিসে, ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ কিডনি রোগে, ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ হৃদরোগে, ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বক্ষব্যাধিতে, ৭ দশমিক ৭ শতাংশ নিউরোলজিক্যাল রোগে, ৪ দশমিক ৩ শতাংশ স্ট্রোক ও ক্যানসারে, ২ দশমিক ৬ শতাংশ থাইরয়েড রোগে এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ গ্যাস্ট্রোলিভার, রক্তজনিত রোগ ও অন্যান্য রোগে ভুগছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই দুই বা ততধিক রোগে আক্রান্ত ছিল।
এত মৃত্যু কেন হচ্ছে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখন যেসব মৃত্যু হচ্ছে, সেটা ডেফিনিটলি ওমিক্রনের প্রভাব।’
তিনি বলেন, ‘ওমিক্রনে মৃত্যু হচ্ছে। এখন তা কোথায় গিয়ে থামে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ওমিক্রন অন্য কোনও ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে কোনও অংশে কম না।’
‘তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করতে হবে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। অধিকাংশই যে ভ্যাকসিনেটেড (টিকাগ্রহীতা) নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে তারা শনাক্ত হয়েছেন কবে সেটা যদি বের করা যায় তাহলে এ মৃত্যু নিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে’, বলেন তিনি।
তবে আমার ধারণা, যখন থেকে ওমিক্রনের ঢেউ শুরু হলো, অর্থাৎ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ—তারপর থেকে এসব রোগী আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এসব মৃত্যু নিয়ে আরও তথ্য-উপাত্ত দরকার।’ বলেন ডা. মুশতাক।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা ‘একদম এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা রয়েছে’ বলে বলেন।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন আগেও সংক্রমণ অনেক ছিল, দৈনিক রোগী শনাক্তের হার ছাড়িয়ে গেছে ডেল্টার সময়কেও। সেসময়ের মৃত্যুর ইফেক্ট হবে তিন থেকে চার সপ্তাহ পরে। যার ফলে আমরা তখনি জানতাম, এভাবে রোগী বাড়ার ফলে সেভাবে মৃত্যুটাও হবে। এটা তখনই বোঝা গিয়েছিল।
‘দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে যে ওমিক্রনের চূড়াতে ছিলাম আমরা, তার ফলাফল এই মৃত্যু”।
আর সব মৃত্যুই ওমিক্রনে হচ্ছে না। ৮০ শতাংশ যদি ওমিক্রনের প্রভাব হয়, বাকি ২০ শতাংশ ডেল্টা জানিয়ে অধ্যাপক সহিদুল্লা বলেন, এসব কিছুর জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে না। কিন্তু যেটুকু হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, ডেল্টাতে এখনও মৃত্যু ওমিক্রনের তুলনায় বেশি।
তবে এখন যেভাবে দৈনিক শনাক্ত হচ্ছে, তার তুলনায় মৃত্যু কমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে আজ যে ৪০ এর বেশি মৃত্যু হলো, আরও কয়েকদিন মৃত্যু এভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। আমার ধারনা ঠিক দুই সপ্তাহ পরে মৃত্যু কমে আসবে আবার।
“আগে আমরা দেখেছি, সংক্রমণের পিকৃ এখন তো তার থেকে নামছি আমরা, সেভাবেই মৃত্যুর পিকে রয়েছি আমরা কিছুদিন, আরও কিছুদিন মৃত্যুর পিকে থাকবো, তারপর থেকে মৃত্যুর চূড়া থেকে নামা শুরু করবো”।
তাহলে এসব মৃত্যু নিয়ে পর্যালোচনা দরকার কিনা—প্রশ্নে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই পর্যালোচনা দরকার। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, মৃত্যুর পর্যালোচনা দরকার। ডেল্টাতে কত শতাংশ, ওমিক্রনে কত শতাংশ, তাদের মধ্যে কতজন টিকা পেয়েছে, কতজন পায়নি-এসবের পর্যালোচনা দরকার।
যদিও কিছুটা গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু তার ব্যাপ্তি আরও বাড়ানো হলে আমরা অনেক তথ্য পেতাম এবং তাতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সুবিধা হতো—জানিয়ে অধ্যাপক সহিদুল্লা বলেন, আইইডিসিআর ( রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) গবেষণা করছে, তবে তার ধারাবাহিকতা যেন থাকে-সে অনুরোধ করছি আমি।
কোভিড-১৯ জাতীয় কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি মৃত্যুর পর্যালোচনা দরকার। না হলে হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দিতে পারবো না।
আগে থেকেই যদি জানা যায়, করোনা আক্রান্ত রোগীর ডায়াবেটিস রয়েছে, সে অনুযায়ী চিকিৎসা হবে, তার গড়পড়তা চিকিৎসা দেওয়া হবে না।
আর মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বমুখীতার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওমিক্রনের চূড়ার সময়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মৃত্যু হচ্ছে। এই মৃত্যুর ধারা আরও কিছুদিন চলবে।
তবে সঙ্গে ডেল্টাও রয়েছে। তাই এসব নিয়ে গবেষণা, পর্যালোচনা করতে হবে—বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
করোনায় মৃত্যু ৩৩ : মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭০৩ জনে।
বুধবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, একই সময়ে নতুন করে আরও ৮ হাজার ১৬ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এতে করে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৭১ জনে।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয় ৪২ হাজার ৫৬৪ জনের। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এর আগে, মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দেশে করোনাভাইরাসে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন আরও ৮ হাজার ৩৫৪ জন।
এদিকে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ কোটি ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৯৯ জন এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭ লাখ ৮১ হাজার ৫৭০ জনে। আর সুস্থ হয়েছেন ৩২ কোটি ৬ লাখ ৩ হাজার ৩৫৭ জন।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৩ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে ৯ লাখ ৩২ হাজার ৪৪৩ জনের।
আক্রান্তে দ্বিতীয় এবং মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত করোনায় ৪ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৫২ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ৫ হাজার ৩০৮ জনের।
আক্রান্তে তৃতীয় ও মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত মোট সংক্রমিত হয়েছেন ২ কোটি ৬৭ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৪ জনের।
আক্রান্তের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে থাকা ফ্রান্সে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ কোটি ৮ লাখ ৪ হাজার ৩৭২ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন এক লাখ ৩২ হাজার ৯২৩ জন।
পঞ্চম স্থানে থাকা যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছেন এক কোটি ৭৯ লাখ ৩২ হাজার ৮০৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন এক লাখ ৫৮ হাজার ৬৭৭ জন।
আক্রান্তের তালিকায় রাশিয়া ষষ্ঠ, তুরস্ক সপ্তম, ইতালি অষ্টম, জার্মানি নবম ও স্পেন দশম অবস্থানে রয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশে অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৪০তম।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২৪টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।