বিশেষ প্রতিনিধি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার মাদক কারবারিদের চিনতেন স্থানীয় যুবক শুভ সরকার। একসময় তিনি মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁর দেওয়া তথ্যে পুলিশ একে একে কারবারিদের গ্রেপ্তার করতে থাকে। এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রকরা। সে অনুযায়ী রায়েরবাজার কমিউনিটি সেন্টার গলিতে তাঁকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে এই ঘটনার সময় অবশ্য এসবের কিছুই জানা যায়নি। তাই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন নিহতের বাবা গোলাপ সরকার। প্রথমে থানা পুলিশ এবং পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটির তদন্ত করে। এর মধ্যে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার, আদালতে জবানবন্দি ও ধারাবাহিক তদন্তে বেরিয়ে আসে বিস্তারিত। মামলাটির সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর ঢাকা মহানগর উত্তরের পরিদর্শক মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, পেশায় গাড়িচালক ছিলেন শুভ। একসময় তিনি মাদক সেবন করতেন। এ কারণে তাঁকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাও দিতে হয়। পরে তিনি সুস্থ জীবনে ফিরে আসেন। এদিকে একসময় মাদক সেবনের কারণে এলাকার সব মাদক কারবারি ছিল তাঁর পরিচিত। মাদকমুক্ত হওয়ার পর তিনি তাদের কারবারে বাধা হয়ে দাঁড়ান। খুন হওয়ার দিনও তিনি দু’জনকে ধরিয়ে দিয়েছেন। এটাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।এজাহার সূত্রে জানা যায়, মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজার এলাকার জাফরাবাদ মসজিদ গলিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ২৬ বছর বয়সী শুভ। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টার সময় তিনি বাসা থেকে বের হন। এক ঘণ্টা পরও বাসায় না ফেরায় স্ত্রী তানিয়া আক্তার তাঁকে ফোন করেন। তখন তিনি জানান, স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার গলিতে আছেন; কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবেন। পরে মা রাশিদা বেগম বারবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এক পর্যায়ে রাত সোয়া ১০টার দিকে তিনি ফোন রিসিভ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মা, আমাকে বাঁচাও।’ তাঁর বিপদ অনুমান করে পরিবারের সদস্যরা কমিউনিটি সেন্টার গলিতে ছুটে যান।
সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, শেরেবাংলা আইডিয়াল স্কুলের পাশে কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাঁর বুকে-পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে। তাঁর চিৎকার শুনে লোকজন এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তখন শুভকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বজনরা সেখানে গিয়ে তাঁকে সংকটাপন্ন অবস্থায় পান। এর পর চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে নেওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ঘটনায় মামলা হলে জড়িত অভিযোগে মো. সবুজ, রাকিব হোসেন, মো. সুমন, মো. পলাশ ও মো. রিয়াজকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। সেই সঙ্গে কাফরুল থানার মামলায় কারাগারে থাকা সুমন ওরফে পেট কাটা সুমন, খোকন সরকার ও মো. ভুবনকেও মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর সবুজ, খোকন ও পেট কাটা সুমন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সার্বিক তদন্ত শেষে আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। তবে বাদী এতে নারাজি আবেদন করলে মামলাটি অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা জানান, আসামিদের মধ্যে পেট কাটা সুমন ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে শুভর বুকে এবং পরে পিঠে ছুরিকাঘাত করে। শুভ বাঁচার জন্য দৌড় দিলে সুমনও তাঁর পিছু নেয়। তবে গুরুতর আহত ভুক্তভোগী সাকসেস স্কুলের গলিতে গিয়ে পড়ে যান। তখন জড়িত অন্যরা যে যার মতো পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা রাখা সুমন রিকশা চালানোর পাশাপাশি হেরোইন বিক্রি করত। গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দিতে নাম আসা রুহান ও শান্তর প্রকৃত নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতি চেয়ে সম্প্রতি চার্জশিট জমা দেয় পিবিআই।