বিশেষ প্রতিনিধি রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক যেন এখন আতঙ্কের স্পট। ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধ ও দুর্ঘটনা ঘটছে এই সড়ক ও এর আশপাশে। সৌন্দর্যবর্ধনে বিমানবন্দর সড়কের দু’পাশে রয়েছে নানা গাছগাছালি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লতাগুল্মের ঝোপঝাড়। রাত যত গভীর হয়, ততই সাধারণ মানুষের কাছে অনিরাপদ হয়ে ওঠে সড়কটি। পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই বেপয়োরা গাড়ি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দর সড়কে বাস, পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকচালকরা পাল্লা দিয়ে চালান গাড়ি। সর্বশেষ গত শুক্রবার বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছেন মোটরসাইকেল আরোহী প্রকৌশলী মইদুল ইসলাম সিদ্দিক শুভ। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের টিনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে বাসটি।
এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে রাস্তার পাশের ঝোপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন।
জানা যায়, বিমানবন্দর সড়কে দুর্ঘটনার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অন্যতম কারণ হলো, রাজধানীর অন্য যে কোনো সড়কের চেয়ে সড়কটি প্রশস্ত ও সোজা। বিশেষ করে বনানীর কাকলী থেকে বিমানবন্দর গোলচত্বর পর্যন্ত রাস্তায় বাধাহীন চলতে পারে গাড়িগুলো। এতে চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। এক চালক আরেক চালকের আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন। আর চাপ কম থাকলে বেপরোয়া থাকেন চালকরা। ফলে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে অসাবধানতাবশত পার হওয়ার সময় বাসের ধাক্কায় বা চাপায় হতাহত হয়। এ ছাড়া অনেকেই মোবাইল ফোন কানে নিয়ে সড়ক পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের অদূরে ইউলুপ ও কাওলা বাসস্ট্যান্ডে বাসযাত্রী ওঠানামা করেন। সেখানে আগে যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন চালকরা।
টঙ্গীর বাসিন্দা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমি চাকরিসূত্রে প্রতিদিন বিমানবন্দর সড়কে মোটরসাইকেল নিয়ে যাতায়াত করি। ওই সড়কে মোটরসাইকেল নিয়ে উঠলে ভয়ে থাকি। বিভিন্ন যানবাহন, বিশেষ করে বাসের গতি থাকে বেপরোয়া।’
একের পর এক দুর্ঘটনা
গত শুক্রবার সকালে স্ত্রী ইরানী চৌধুরীকে বনানীর বিদ্যানিকেতন স্কুলে চাকরির পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে সিভিল এভিয়েশনের সিনিয়র সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মইদুল ইসলাম সিদ্দিক শুভ কাওলার বাসায় ফিরছিলেন। রাইদা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলসহ মইদুলকে চাপা দিয়ে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের টিনের নিরাপত্তা বাউন্ডারি ভেঙে ভেতরে চলে যায়। এতে মইদুল ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাসটির ফিটনেস, রুট পারমিট ও ট্যাক্স টোকেন কিছুই ছিল না। চালক হাসান মাহমুদ হিমেল পালিয়ে যান।এর আগে ২৭ মার্চ বিমানবন্দর সড়কে খিলক্ষেত এলাকায় গ্লোরী আজমেরী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়। এর ১১ দিন আগে বিমানবন্দর থানা এলাকায় ট্রাকচাপায় আল আমিন নামে এক তরুণ নিহত হন। ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর বলাকা ভবন এবং গোলচত্বরের মাঝামাঝি স্থানে রাস্তা পার হওয়ার সময় হুমায়ুন কবির নামের এক ব্যক্তি পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় নিহত হন।২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কের র্যাডিসন ব্লু হোটেলের বিপরীতে শহীদ বীরবিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪ শিক্ষার্থীর ওপর জাবালে নূর পরিবহনের বাস তুলে দেন চালক। এতে দুই শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম ঘটনাস্থলেই মারা যান; আহত হন ১২ জন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে গৃহকর্মী রোজিনা বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় বাসের চাপায় গুরুতর আহত হন। কাটা পড়ে তাঁর ডান পা। ৯ দিন পর মারা
যান তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. এম শামসুল হক বলেন, বিমানবন্দর সড়কটি রাজধানীর অন্য রাস্তার চেয়ে চওড়া ও বাধাহীন। কোনো মোড় নেই। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও নেই। এসব কারণে চালকরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালান। বাসগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নামে। মোটরসাইকেল আরোহীরাও একটু ফাঁকা পেলে ঢুকে পড়ে। ফলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। দ্রুতগতিতে চলতে চাওয়া এবং বিশৃঙ্খলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।থেমে নেই অপরাধ গত ৬ এপ্রিল বিমানবন্দর এলাকায় তিন ছিনতাইকারীকে সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে গত অক্টোবরে খিলক্ষেত এলাকা থেকে এক যুবককে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। পরে ওই যুবককে উদ্ধার ও চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, মানুষের মধ্যে ট্রাফিক সচেতনতা নেই। তুলনামূলক রাস্তা বড় পেয়ে চালকরা এ সড়কে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। এটাই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।গুলশান ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার আব্দুল মোমেন বলেন, রাস্তা পারাপারে মানুষকে হতে হবে সচেতন। সবাইকে মানতে হবে ট্রাফিক আইন। দক্ষ চালক গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।