ক্রাইম ডেস্কঃ ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরের রসুলপুরে কিশোর সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে খুন হয় মো. রিপন নামের অপর এক কিশোর। স্থানীয়রা জানান, পূর্ব রসুলপুরে তার বাসার কাছে স্থানীয় আরেক কিশোর মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে দুই কিশোরের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে কয়েকজন মিলে রিপনের পেটে ছুরিকাঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলে সে মারা যায়। এ ঘটনায় পুলিশ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। যাদের ৪ জনই কিশোর। রিপন হত্যাকান্ডের দুই সপ্তাহ আগে ওই এলাকায় সানোয়ার হোসেন নামের আরেক কিশোর খুনের শিকার হয়। এই হত্যাকান্ডেও একটি কিশোর গ্যাং জড়িত।
কামরাঙ্গীর চর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় এই অপরাধীদের নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েছেন। তার ভাষ্য, প্রতিদিন নানা অপরাধের জন্য ১০/১২ জন কিশোরকে আটক করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিতে না পারায় মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এতে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু কামরাঙ্গীর চর থানা এলাকাতেই নয়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশেই কিশোর অপরাধীরা এতটাই তৎপর, যা সামাল দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা একবাক্যে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলও উদ্বিগ্ন।
জানা গেছে, গত এক বছরে শুধু রাজধানীতেই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৩০ কিশোর খুন হয়েছে। এ ছাড়া খুদে অপরাধীদের হাতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের সংখ্যাও উদ্বেগজনক। এ প্রসঙ্গের্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কিশোর গ্যাং বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দ্রম্নত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অপরাধ পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াবে।
যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের র্(যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন বলেন, যেভাবেই হোক কিশোর গ্যাং কালচারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কোনোভাবে আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। এর জন্য দরকার জনসচেতনতা।
পুলিশ সূত্র বলছে, রাজধানীতে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তদন্তে এর বেশিরভাগ ঘটনায় কিশোরদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। শুধু ঢাকাতেই নয়, অন্যান্য বিভাগীয় শহর, এমনকি জেলা শহরগুলোতেও কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে মিরপুর ও উত্তরায় সবচেয়ে বেশি। গ্যাং সদস্যদের মধ্যে অনেকে নামি-দামি স্কুলের শিক্ষার্থী। তারা ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেবে যে তরুণ প্রজন্ম, সেই কিশোর-তরুণরা যেন পথ না হারায়, এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কিশোর সংশোধনাগারে স্থান সংকুলান হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
তিন-চার বছর ধরে কিশোর গ্যাং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে জানিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ডক্টর বেনজীর আহমেদ বলেন, কিশোর আইন হালনাগাদ করা হয়েছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দরকার।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তারা একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছে। ওই তালিকা ধরে ওই কিশোরদের আইনের আওতায় আনতে বিশেষ পরিকল্পনা চলছে।
তবে আইনি এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন, সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলার সুযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সামাজিক যে অনুশাসনগুলো ছিল সেগুলো সমাজে কাজ করছে না। যেমন সমাজের ভেতর পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা, বন্ডিং- এগুলো নষ্ট হয়ে ছন্দপতন ঘটেছে। এছাড়া সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও খেলাধুলা একদমই নেই। এসব কারণে কিশোর-তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুযোগ কমে যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের সুযোগ কমে যাওয়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ না নেওয়াও অপরাধ-প্রবণতার বড় কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ অবস্থায় পরিবারের পাশাপাশি, সামাজিক সব সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শুধু রাজধানীতেই ৬০টি কিশোর গ্রম্নপ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি গ্রম্নপ করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদের মধ্যে রাজধানীর ধোলাইরপাড় এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে- রাহাদ, ফিয়াদ, রাশেদ, ইসমাইল, ফিরোজ, বাদল, রাসেল, সাগর, জনি, গুটি হৃদয়, মফিজ, এহসান, আতিক ও সুমন ওরফে ফরমা। কুতুবখালীতে মজনু, হিদর, মুকুল, সাহেদ ও ইমন। যাত্রাবাড়ীতে রাজু, রমজান, মোবারক, খোকন, হাবু, রাসেল, পারভেজ, অনিক, আহসান, রাজীব, নুর মোহাম্মদ, সবুজ, বাবু, ইউসুফ, হায়দার, রতন, সুজন, জালাল, সাইফুল, আলম, শোভন ও শুভ। কাজলা এলাকায় ফরমা খোকন, সুমন, শাহিন, আলম, হানিফ, রাসেল, পারভেজ, অনিক ও রুবেল। শনির আখড়ায় রাতুল, রেজা, সাগর, শুভ, রিপন ও রিংকু। সায়েদাবাদে মিঠু, ফিরোজ, আশিক, মাসুম, ইকবাল, সোবহান, সুমন, শাহিন, সোহেল, রানা, নিজাম, খোকন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়াও রাজধানীর বাকি এলাকার তালিকাও ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, নানান ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় কিশোরদের নিয়ে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। উদ্বিগ্ন অনেক অভিভাবক সন্তানকে বাগে আনতে না পেরে এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় সরে গেছেন। অনেকে আবার স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তাতেও তাদের বিপদ কাটছে না। কারণ উচ্ছৃঙ্খল এসব সন্তান নতুন এলাকায় গিয়ে আবার সেখানকার খুদে অপরাধীদের দলে ভিড়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপথগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা যথেষ্ট কষ্টকর। এজন্য অভিভাবকদের আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কখন বাসায় ফিরছে, কোথাও কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিনা এবং মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে কিনা তা কঠোরভাবে মনিটর করা জরুরি। অভিভাবকরা সচেতন হলে কিশোর সন্তানদের বিপথগামী হওয়ার সুযোগ খুবই কম বলে মনে করেন তারা।
র্যবের ডিজি চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ছোটদের সঙ্গে বড়রাও থাকে। ছোট-বড় মিলে বিরোধ হয়, পরে আলাদা গ্রম্নপ সৃষ্টি হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি, এমনকি খুনোখুনির মতো ঘটনা ঘটে। তাই কিশোর অপরাধ দমনে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে তার মানে এই নয়, আভিযানিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। যদি কেউ সচেতনতা কর্মসূচির মাধ্যমে সুপথে না আসে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা চলমান থাকবে বলে জানানর্ যাব ডিজি।