বিশেষ প্রতিনিধি রাজধানীর মালিবাগে একটি হাসপাতালে গত ২০ ফেব্রুয়ারি খতনা করাতে গিয়ে অপারেশন থিয়েটারে মারা যায় ১০ বছরের শিশু আহনাফ তাহমিদ আলম আয়হাম। আজ মঙ্গলবার তার মৃত্যুর এক মাস ১৯ দিন পূর্ণ হবে। এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তার পরিবারের সদস্যরা। ঈদের আনন্দ তো ফিকে হয়ে গেছেই, সে সঙ্গে ছোট্ট তাহমিদের স্মৃতি এখনও শোকের প্রান্তরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। গতকাল সোমবার খিলগাঁও এলাকায় তাহমিদদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাসাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোট্ট শিশুটির অসংখ্য স্মৃতি। এখনও পড়ার টেবিলে বই, নোটবুক ও ছবিতে হাসছে তাহমিদ। কাঁদতে কাঁদতে মা খায়রুন নাহার চুমকি জানান, ছোট ছেলে আহিন আলম আয়মান (৬) ভাইয়ের প্রিয় গরুর মাংস আর ভাত থালায় নিয়ে তাহমিদের কবরের কাছে যেতে চায়। বলে– ভাইয়ার পছন্দ, ওকে একটু দিয়ে আসি।
খায়রুন নাহার চুমকি বলেন, ‘আমি এখনও ছেলের স্মৃতি বলতে পারি না কাউকে। তাহমিদের কিছু কথা আর স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে। কিছু কথার অর্থ এখন বুঝতে পারছি। যাতে মনে হচ্ছে, ও আমাদের রেখে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাহমিদ আমার কোলজুড়ে আসার পর থেকে ঈদে সব সময় ওর পোশাকের সঙ্গে মিল রেখে পোশাক কিনতাম। এবার সাদা পোশাকেই ঈদ হচ্ছে আমার। তাহমিদ মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে বলে– আম্মু, এবার ঈদে তুমি সাদা রঙের পোশাক নিবা। এটা ও কীসের জন্য বলল, বুঝি নাই। এ ছাড়া মারা যাওয়ার ওই মাসে হঠাৎ তার নানাভাইয়ের কবর দেখতে কুমিল্লায় যেতে চায়। খতনা করানো হবে বলে যাওয়া হয়নি। কয়েক দিন পরই তাহমিদ একেবারে তার নানার কাছে চলে গেল।কলেজ জীবনে সাদা পোশাক তার বেশ প্রিয় ছিল জানিয়ে চুমকি বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুর পর থেকে আর কখনও ভয়ে সাদা পোশাক পরি না। কারও গায়ে দেখলেও কেমন ভয় লাগে। আর সেই পোশাক এবার ঈদে পরতে বলেছিল তাহমিদ। ওকে বলছিলাম, বাবা, আমার ভয় লাগে। কিন্তু নাছোড়বান্দা বলে– আম্মু, ওটা পরলে তোমাকে সুন্দর দেখাবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ঈদে ওর বাবা ছেলের কথা রেখেছে। আমাকে সে একটি সাদা পোশাক কিনে দিয়েছে। ওটা আমি কী করে পরব, জানি না। ঈদে পরিবারের সবাই মিলে ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাব।’
ছেলের স্মৃতিচারণ করতে করতে চুমকি আরও বলেন, ‘তাহমিদ বলত– আমি মায়ের ছেলে আর আহিন বাবার ছেলে। সে আমার জন্য পাগল ছিল। আমাদের বাসায় সাধারণত চাঁদরাত থেকেই ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গান বাজত। সেই সঙ্গে সবাই হৈ-হুল্লোড় করত, মেহেদীর রঙে সাজত ওরা। কিন্তু এখন ঈদ নেই পরিবারে। তাহমিদের মৃত্যুর এতদিন পরও এখনও আহিন রাতে চিৎকার করে কান্নাকাটি করে ওঠে। বৃষ্টি হলে ছাতা নিয়ে যেতে চায়, বলে ভাই ভিজে যাচ্ছে। জানি না কী করে ছোট ছেলে স্বাভাবিক হবে।’
বাসায় তাহমিদের বিভিন্ন স্মৃতি দেখিয়ে তার নানি নাজনীন নাহার বলছিলেন, তাহমিদদের পরিবার ও তার বড় খালা নিজেদের বাড়িতে পাশাপাশি থাকে। আমি ওদের সঙ্গে থাকি। ঈদে চাঁদ ওঠার পর থেকে মার্কেট শুরু হয় মেয়ে ও নাতিদের। এবার ঈদ চলে আসছে, কিন্তু বাসায় কোনো আনন্দ নেই। সব আনন্দ তাহমিদ নিয়ে গেছে। ওর বায়না বা আবদার কখনও কেউ ফেলত না। বাসা মাথায় করে রাখত তাহমিদ।
তাহমিদের বাবা ফখরুল আলম বলেন, ‘তাহমিদ ও আহিন হাঁটতে শেখার পর থেকে ওদের ছাড়া ঈদের নামাজ পড়িনি। দুই ছেলের সঙ্গে মিলিয়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা কিনতাম। বাপ-ছেলে মিলে বায়তুল মোকাররম মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। কিন্তু এবার যাওয়া হবে কিনা, জানি না। তাহমিদ আমাদের এমন করে রেখে গেল, এখনও ভাবতে পারছি না। আগে চাঁদরাত পর্যন্ত মার্কেট চলত। এবার কিছুই কেনা হয়নি। শুধু ছোট ছেলের জন্য কিনেছি।’
ফখরুল আলম আরও বলেন, ‘সুস্থ ও তরতাজা একটা ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফুটফুটে তাহমিদ আমার দুনিয়া অন্ধকার করে চলে গেল। এভাবে যেন আর কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়, সে দোয়া করব।’
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকার জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করার সময় অ্যানেসথেশিয়া প্রয়োগের কারণে অপারেশন থিয়েটারে মারা যায় তাহমিদ। ওই ঘটনার দু’দিন পরে তাহমিদের বাবা ফখরুল আলম হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার আসামিদের মধ্যে জেএস হাসপাতালের পরিচালক এসএম মোক্তাদির, চিকিৎসক মাহবুব মোরশেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুই দফা রিমান্ড শেষে বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই রুহুল আমিন বলেন, ‘চিকিৎসাজনিত অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। এই ঘটনায় কারোর সংশ্লিষ্টতা পেলে ছাড় দেওয়া হবে না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’