একুশ শতকের উত্কর্ষতার যুগে আমরা বসবাস করছি। পৃথিবী অবলোকন করেছে অনেক আশ্চর্যজনক উদ্ভাবন। উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছে অনেক জাতিই। কিন্তু আমরা কি একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী পেয়েছি?
বসবাসযোগ্য পৃথিবীটা মূলত কী? বসবাসযোগ্য পৃথিবী বলতে আমরা সেই পৃথিবী বুঝি, যেখানে অন্তর্নিহিত থাকবে সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বৈষম্যহীনতা, নারীর সমান অধিকার, ন্যায়বিচার, যুদ্ধের দামামার বিপরীতে শান্তির আবহ, ক্ষুধামুক্ত ও সবুজায়িত, গ্রিনহাউজ ইফেক্টমুক্ত একটি ন্যায়ভিত্তিক সহযোগিতাপূর্ণ পৃথিবী। কিন্তু আমরা দৃশ্যত তা দেখতে পাই না।
বর্তমান বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তু গত বছর এএফপির এক জরিপে বলা হয়েছে, চীন গত বছর ২৭ শতাংশ গ্যাস উত্পন্ন করেছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ১৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০ ভাগ। যা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মোট ৫২ ভাগ! আর যদি ভারতকে (৭ ভাগ) সংযুক্ত করা হয় তা দাঁড়ায় ৫৯! এই হলো অন্যান্য রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতন করা দেশগুলোর অবস্থা।
বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোও প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে। যার দরুন বর্তমানে অতিবন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বেড়েই চলছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা। হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলবর্তী নিম্ন এলাকা। মালদ্বীপ তো দেশের বাইরে আশপাশের দেশ থেকে জমি ক্রয় শুরু করেছে। ইদানীং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যে মাত্রায় গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে তাতে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী বসবাস অযোগ্য হয়ে যাবে।
খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও ব্যর্থ হয়েছে একুশ শতকের এই সভ্যতা। জাতিসংঘের ৪৪তম অধিবেশনের সভাপতি নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত জোসেফ গারবা বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে প্রতিদিন অনাহারে প্রায় ৪০ হাজার শিশু না খেয়ে মারা যায়! অথচ বিশ্বে প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্য উত্পাদিত হয় তা খাদ্য চাহিদার দ্বিগুণ!’ আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, পৃথিবীর ২৭০ মিলিয়ন শিশু দাসত্ব, পাচার, শিক্ষাবঞ্চনাসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ২৩০ মিলিয়ন শিশু সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাস করছে! অথচ বিশ্বের সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার দরকার।
অন্যদিকে, উন্নতির এই শীর্ষ সময়ে এসেও পৃথিবীতে ৭০ কোটির বেশি হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করছে। আইএলও এবং ইউনিসেফের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তাতে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা এক লাফে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১১০ কোটিতে!
বিবিএসের প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি ৪৬ লাখ জনগোষ্ঠী আছে। সব মিলিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া ৩ কোটি মানুষ! বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করতে পারলে ঐ ব্যক্তিকে দরিদ্র হিসাবে ধরা হয় না। যা কিনা বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১৫০ টাকা! যা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য মান নয়। তবুও এই দুর্দশা।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, যুদ্ধংদেহি, নারীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ এই বসবাস অযোগ্য পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য পৃথিবী হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সদিচ্ছা প্রয়োজন। গ্রিনহাউজ গ্যাসের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে আমাদের খনিজ জ্বালানির বিপরীত ভাবতে হবে। সৌরশক্তি ব্যবহার করে কীভাবে খনিজসম্পদের চাহিদা পূরণ করা যাবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এসব গবেষণা কাজে বেশি বেশি প্রণোদনা দিতে হবে।
আগামীর প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। ক্ষুধা ও ধর্ষণমুক্ত পৃথিবী গড়তে নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কোনো ধর্মই ধর্ষণ, শ্রেণি বৈষম্য, অন্যায়, পৃথিবী ধ্বংসের কোনো কার্যক্রম সাপোর্ট করে না। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তরুণদের চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। সব শ্রেণির মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এই বসবাস অযোগ্য পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারি। আমরা যদি এখনি সচেতন না হই তাহলে আমাদের আগামীতে আরো বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সবশেষে আমার আহ্বান থাকবে, আসুন আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণ করি।